জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বর্বর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সবশেষ দখলদার বাহিনীর বিমান হামলায় একই পরিবারের ১০ জনসহ ১৫ জন নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলের আলাদা দুই হামলায় এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি এ তথ্য জানিয়েছে। সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেয়া এক পোস্টে বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা ১০ জনের লাশ এবং অনেক মানুষকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন। দক্ষিণাঞ্চলীয় গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের পূর্ব দিকের বানি সুহাইলা এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারি বাহিনীর হামলার শিকার হওয়া বারাকা পরিবারের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িগুলো থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়েছে।’ বাসাল পরে ঘোষণা দিয়েছেন যে, উত্তরাঞ্চলীয় গাজার তাল আল-জাতার এলাকায় আলাদা আরেকটি হামলা হয়েছে। দুটি বাড়িতে এ হামলার ঘটনায় সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা পাঁচটি লাশ উদ্ধার করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেনি।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৪০ জন বাসিন্দা নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছিল সিভিল ডিফেন্স। নিহতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা ছিলেন। ১৮ মার্চ থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নতুন করে অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। তখন থেকে তারা গাজায় বিমান হামলা জোরদার এবং স্থল অভিযান বিস্তৃত করেছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ভেতরে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ আটকা পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। খবর আনাদোলু এজেন্সির।
স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘গাজার ভেতরে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ আটকা পড়েছে। চলমান যুদ্ধ এবং সাহায্য সরবরাহ হ্রাসের ফলে মানসিক চাপের মাত্রা বেড়েছে- বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) এর উদ্ধৃতি দিয়ে ডুজারিক বলেন, গত ২ মার্চ ইসরাইল গাজায় মানবিক সাহায্যসহ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে মানবিক সরবরাহ প্রায় হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ পানি সম্পদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে পানি খাত গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের এই মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি যে, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে স্পষ্ট বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, চিকিৎসা সরবরাহ এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং যখন অন্যথায় সরবরাহ করা হয় না তখন মানবিক ত্রাণ সরবরাহ করা।’ পশ্চিম তীরের বিষয়ে ডুজারিক বলেন, উত্তরে ইসরায়েলি অভিযান অব্যাহত থাকায় হাজার হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং বাড়ি ফিরতে পারছে না।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৫১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। দীর্ঘ ১৫ মাস যুদ্ধের পর গত ১৯ জানুয়ারি কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশরের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এটি ছিল তিন পর্বের। প্রথম পর্বে ছিল যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি-বন্দি বিনিময় শুরু করা, দ্বিতীয় পর্বে ছিল জিম্মি-বন্দি বিনিময়ের কাজ শেষ করা এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, তৃতীয় পর্বে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাকে পুনর্গঠন। তবে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ না করে গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। ইসরায়েলে ফের শুরু করা এই হামলায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া অভিযান শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে দিচ্ছে না দখলদার বাহিনী।
গাজায় অন্তবর্তীকালীন শান্তিচুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস। তারা উলটো সব জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধ সমাপ্তিতে সামগ্রিক একটি চুক্তির দাবি জানিয়েছে। এরসঙ্গে, ইসরায়েলে বন্দি থাকা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি চেয়েছে তারা। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বার্তায় হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা খলিল আল-হায়া বলেছেন, এখন থেকে তারা আর কোনো অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে সম্মত হবে না। হামাস বরং এখনই সামগ্রিক আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ, গাজার পুনর্গঠন এবং ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সব বন্দি বিনিময়।
বিশ্লেষকদের ধারণা, হামাসের এসব দাবি ইসরায়েলের পক্ষ থেকে মেনে নেয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হতে পারে। আল-হায়া বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রেখে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এসব আংশিক চুক্তিতে দিয়ে ইসরায়েলি সরকার তাদের আসল উদ্দেশ্য আড়ালে রাখে। কিন্তু স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের জিম্মিদেরও বলি দিতে পিছপা হবে না তারা। আমরা তাদের এই খেলার অংশ হবো না।
এদিকে, হামাসের দাবির সমালোচনা করে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জেমস হিউইট বলেছেন, হামাসের কথাবার্তায় এটা স্পষ্ট যে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা কেবল অনিঃশেষ নৃশংসতা জিইয়ে রাখতে আগ্রহী। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের শর্ত এখনও একই আছে- জিম্মিদের ছেড়ে না দিলে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। প্রায় ১৫ মাস যুদ্ধ চলার পর গত জানুয়ারিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এক সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে দুমাস যেতে না যেতেই তা ভেঙে পড়ে। এরপর থেকেই তা পুনরায় কার্যকর করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন মিসরের মধ্যস্থতাকারীরা। তবে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে সে চেষ্টায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফিলিস্তিনি ও মিসরীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি পুনরায় কার্যকর এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে গত সোমবার কায়রোতে আয়োজিত বৈঠক তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।
ইসরায়েল ৪৫ দিনের জন্য গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, এই বিরতিতে অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তির সুযোগ তৈরি হবে এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে পরোক্ষ আলোচনা শুরু করা যাবে। অবশ্য, এরইমধ্যে ইসরায়েলের অস্ত্রসমর্পণের শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস। তাদের দাবি, কেবল যুদ্ধ সমাপ্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তির অংশ হিসেবেই বাকি বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।
এদিকে ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের জিম্মি ও মিসিং ইন অ্যাকশন ইউনিটের প্রাক্তন প্রধান রামি ইগ্রা বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হবেন। গত বুধবার রেডিও ১০৩ এফএমণ্ডএ ইগ্রা এমন মন্তব্য করেন। হামাসের সঙ্গে বন্দি বিনিময়ের জন্য ইসরায়েলি প্রস্তাবকে ‘প্রতিরোধ আন্দোলনের কাছে উপস্থাপিত সবচেয়ে কঠিন প্রস্তাব’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রাক্তন সিনিয়র মোসাদ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারব যে, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। কেন ইসরায়েল রাষ্ট্র এই প্রস্তাবটি পেশ করেছে, যা স্পষ্টতই কেউ গ্রহণ করবে না। তারা এতে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যদিও এটা স্পষ্ট যে, হামাস শুরু থেকেই তার টিকে থাকার জন্য কাজ করে আসছে এবং তারা এতে রাজি হবে না।’ যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রস্তাব নিয়ে মোসাদ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নেতানিয়াহু জানে যে, সময় ফুরিয়ে আসছে। এটা বন্দি সৈন্যদের জন্য নয়, বরং তার জন্য। নেতানিয়াহুকে যে সংবাদ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, ট্রাম্প স্পষ্টভাবে সেখানে বলেছিলেন যে, যুদ্ধ শেষ হতে হবে এবং এটি দ্রুত শেষ হবে।’ ইগ্রা আরও উল্লেখ করেছেন যে, এটা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ যে ট্রাম্প শিগগিরই সৌদি আরব সফর করবেন। যারা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাধান দাবি করছে।
ইগ্রা আরও বলেন, ‘এই সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে, নেতানিয়াহুর কাছে এটা স্পষ্ট যে, তারা যেমন তাকে প্রথম পর্যায় (যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি বিনিময় চুক্তির) বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করেছিল, তেমনি তারা তাকে দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করবে। যার মধ্যে মিশরীয় সমাধান অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে গাজায় একটি প্রশাসনিক কমিটির শাসন থাকবে।’ তিনি যুদ্ধে ইসরায়েলের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি এবং আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।’ সাবেক এই মোসাক প্রধান আরও বলেন, ‘বিষয়টি দ্রুত ইরানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নেতানিয়াহু ‘লিবিয়ার মতো ভেঙে ফেলার’ বাক্যাংশ ছড়াচ্ছেন, যেখানে আমেরিকানরা তার কথা শুনছে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, নেতানিয়াহু আমাদের এখানে হামাসের শাসনের বিকল্প ছাড়াই নিয়ে এসেছেন। তিনি তার রাজনৈতিক অংশীদারদের কারণে ও পরিস্থিতি সমাধানের ভয়ে দেড় বছর নষ্ট করেছেন।’