গাছের ডগায় ঝুলছে লাল টুকটুকে টমেটো, আর মাটির নিচে একই গাছে ধরে আছে আলু। এই বিশেষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজির নাম ‘টমালু’। গ্রাফটিং বা জোড় কলম পদ্ধতিতে একই সঙ্গে আলু ও টমেটোর চাষাবাদে সফলতা অর্জন করেছেন কৃষি কর্মকর্তা রুবেল মিয়া। শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা চৌকিরঘাট এলাকায় ‘কৃষি বন্ধু এগ্রো সার্ভিসেস’ নার্সারির সহায়তায় পরীক্ষামূলকভাবে তিন শতক জমিতে টমালুর চাষ শুরু করেন। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি।
রুবেল মিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) থেকে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সে সময় ব্যবহারিক ক্লাসে এমন চাষাবাদ সম্পর্কে ক্লাস করেন তিনি। ভার্সিটি জীবন শেষ করে কৃষি খাতে কাজ শুরু করেন। হাইওয়ের পূর্বপাশে নিজ বাড়ির পাশে পাঁচ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘কৃষিবন্ধু এগ্রো ফার্ম’ নামে একটি আধুনিক নার্সারি। কিছুদিন পরই কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। নিজ নার্সারিতে তিনি নিয়মিত নতুন নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ‘টমালু’ চাষ তার অন্যতম সফল উদ্যোগ। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে বেগুন গাছে গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। কৃষি কর্মকর্তা রুবেল মিয়া বলেন, শখের বশে মূলত আলু ও টমেটো একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই চাষে সফলতা এসেছে। ‘টমালু’ গাছে রুটস্টক বা গোড়া হিসেবে আলুর চারা আর সায়ন হিসেবে টমেটোর চারা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে দুটি চারার বয়সই সমান হতে হবে। গ্রাফটিং পদ্ধতিতে ডায়মন্ড, কার্ডিনাল ও এস্টোরিক জাতের আলুর সঙ্গে বাহুবলী জাতের টমেটোর চারা জোড়া দিয়ে তিন শতক জমিতে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করি। এতে সফলতা পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, খরচ কম হলেও ফলন বেশ ভালো হয়েছে। তা ছাড়া দিন দিন দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। তাই একই গাছে একাধিক ফসল হলে সুবিধা। এই পদ্ধতিতে পরিচর্যাতেও কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। একই জমিতে কাপ করে একই খরচ ও একই জৈবসার ব্যবহার করায় এ পদ্ধতি কৃষকের জন্য লাভজনক। আলুর গাছে কলম করাও বেশ সহজ। যারা গ্রাফটিং করে তাদের কাছ থেকে শিখে নিজেরাই করা যায়। গ্রাফটিংয়ের ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই গাছ জোড়া লেগে যায়। নিজের নার্সারিতে সফলতা পাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের কাছে এ উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রুবেল মিয়া।
গ্রাফটিং পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি জানান, প্রথমে আলাদা জায়গায় টমেটো ও আলুর চারা তৈরি করে নিতে হবে। চারা গাছের উচ্চতা যখন ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার তখন আলু চারার সঙ্গে টমেটো চারা গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে জোড়া লাগিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আলু চারার আগা ও টমেটো চারার গোড়ার অংশ কেটে নিতে হবে। জোড়া লাগলে পলিথিন খুলে ফেলতে হবে। বর্তমানে কৃষিবন্ধু এগ্রো ফার্মের দায়িত্বে আছেন নারী উদ্যোক্তা জান্নাতি খাতুন। তিনি জানান, টমালুর প্রতিটি গাছে প্রায় সাড়ে ৪ কেজি করে টমেটোর ফলন হয়েছে। অন্যদিকে আলুর ফলন হয়েছে এক কেজি ১০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত। অনেকেই শুনে এ পদ্ধতি দেখতে আসছেন এবং তাদের ছাদবাগানে এই চাষ করবেন বলে ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন।
শিবগঞ্জ উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইফুর রহমান পাপ্পু জানান, প্রথমে আলু গাছের উপরের অংশ কেটে সেখানে টমেটোর চারা গ্রাফটিং করা হয়। ফলে একই গাছ থেকে আলু ও টমেটো দুটিই পাওয়া যাচ্ছে। আলু সংগ্রহের পর মাটিতে পুনরায় গাছ ঢেকে পানি দিলেই চার মাসের মধ্যেই টমেটোর পূর্ণ ফসল পাওয়া সম্ভব। যা কৃষকের জন্য সাশ্রয়ী ও লাভজনক।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, উত্তরবঙ্গের শস্যভাণ্ডার খ্যাত বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলার আবহাওয়া ও মাটি বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ফসল উৎপাদনেও এসেছে বৈচিত্র্য। রুবেল মিয়ার সফল পরীক্ষামূলক উদ্যোগে কৃষি অফিস সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।