ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনে ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট’ ব্যাপক কার্যকর

নিরাপদ ফসল উৎপাদনে ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট’ ব্যাপক কার্যকর

শেরপুরের নকলায় স্বল্প খরচে ও সহজ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও লিচেট ব্যবহারে কৃষকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন তারা। ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ব্যবহারে মাটির গঠন ও বুনট উন্নত করার পাশাপাশি পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও পানির অপচয় রোধ হয়। এছাড়া মাটির অম্লত্ব¡ ও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে কৃষকের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে এ প্রযুক্তি।

এই কম্পোস্ট সার উৎপাদনের সময় তরলজাতীয় যে পদার্থ তৈরি হয় তাকে লিচেট বলে। এই লিচেট কৃষকরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন শাক সবজি ও পানের বরজে ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ফসলের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে বাংলাদেশের চর এলাকায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন চর এলাকায় ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট’ উৎপাদন প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত অতিউপকারী কম্পোস্ট সার জমিতে ব্যবহার করে নিরাপদ ফসল পাচ্ছেন কৃষকরা।

এরইমধ্যে উপজেলার চরাঞ্চলের দুই গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষক-কৃষানি এই প্রযুক্তিতে জৈব সার ও বালাইনাশক লিচেট উৎপাদন ও ব্যবহার করছেন। তারা ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের সময় যে লিচেট সংগ্রহ করেন তা পানের বরজ ও বিভিন্ন শাক-সবজি চাষে ব্যবহার করে খুব উপকৃত হচ্ছেন। এর সুবিধা দেখে উপজেলার অন্য এলাকার কৃষকের মধ্যেও এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহারে আগ্রহ বেড়েই চলছে।

কৃষকরা জানান, টিন বা খড়ের চালাসহ একটি ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট পাকা চৌবাচ্চা অথবা স্যানিটারি রিং দ্বারা বানানো হাউসে ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরি করতে হয়। এটি তৈরিতে ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে ৪ হাত বাই ২ হাত মাপের দুইটি চেম্বার তৈরি করা হয়। প্রথমে ১২ লিটার পানির মধ্যে ১০০ গ্রাম ট্রাইকো-কম্পোস্ট পাউডার, ৪ কেজি খৈল, ৪ কেজি চিটাগুড় মিশ্রিত করে লেই তৈরি করা হয়। চেম্বারে স্তূপ হতে ৮ ইঞ্চি সমপরিমাণ বর্জ নিয়ে সেখানে ৫ কেজি লেই নিয়ে তাতে ৫ লিটার পানি দিয়ে পাতলা করে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এই মিশ্রিত পানি চেম্বারের ৮ ইঞ্চি স্তূপে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পরে স্তূপ কোদাল দিয়ে ভালোভাবে উলট-পালট করে দিতে হয়। এভাবে ৮ ইঞ্চি পর পরস্তূপ তৈরি করে চেম্বারটি পূর্ণ করে উপড়ে পাটের ছালা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। পরে প্রতি সপ্তাহে চেম্বারের মিশ্রন উলট-পালট করে দিলে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার ও লিচেট পাওয়া যায়। এভাবে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে উৎকৃষ্টমানের জৈব সার তৈরি করা হয়। ১০ থেকে ১৫ দিন পর হতে চেম্বারের নিচের ছিদ্র দিয়ে যে তরল পদার্থ বের হয় তা বালাইনাশক হিসেবে কৃষকরা জমিতে স্প্রের মাধ্যমে ব্যবহার করেন। এই মিশ্রনটি ভিটামিনের মতো কাজ করে বলে মন্তব্য করেন কৃষকরা।

এছাড়া ২৮ শতাংশ গোবর, মুরগির বিষ্ঠা ৩৬ শতাংশ, শাক-সবজির অবশিষ্টাংশ ৫ শতাংশ, কচুরিপানা ২৫ শতাংশ, কাঠের গুঁড়া ৩ শতাংশ, নিমপাতা ১ শতাংশ ও চিটাগুড় ২ শতাংশ অনুপাতে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এক মেট্রিকটন মিশ্রণ পচাতে ৫০০ মিলি ট্রাইকো ড্রামা অণুজীব মেশাতে হয়। এতে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে জৈব পদার্থ পচে উৎকৃষ্টমানের ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও বালাইনাশক লিচেট উৎপন্ন হয়।

কৃষকরা আরও জানান, ট্রাইকো কম্পোস্ট সারের মূল উপাদান হিসেবে ট্রাইকোডার্মা পাউডার ব্যবহার করা হয়। ট্রাইকোডার্মা মূলত মাটিতে মুক্তভাবে বসবাসকারী একটি উপকারী অনুজীব ছত্রাক। এটি মাটিতে বসবাসকারী ক্ষতিকর জীবাণু যেমন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকর অনুজীবের মৃত্যু ঘটিয়ে পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। ফলে এ জৈব সার মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করে, মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সাহায্য করে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা কমাতে সাহায্য করে, মাটির অম্লত্ব ও পিএইচ মানের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি করাসহ মাটি ও ফসলের উপকার করে।

সরেজমিন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী উপজেলার নারায়নখোলা সিকদার পাড়াঘাট এলাকার কৃষক মঞ্জুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রাইকো কম্পোস্ট সার একটি উন্নতমানের জৈবসার। এটি উৎকৃষ্টমানের জৈবসার হওয়ায় জমিতে ব্যবহারের ফলে ফলন ভালো হয় এবং ফসলে রোগ-জীবানু অপেক্ষাকৃত কম হয়। এটি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে এবং জৈব বালাইনাশক হিসেবে ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্লান্টের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষকরা নিজের জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি অতিরিক্ত জৈবসার কিছু কিছু বাজারজাত শুরু করেছেন। প্রতিটি ট্রাইকো-কম্পোস্ট প্লান্ট হতে ৪৫-৫০ দিনে প্রায় ৯ থেকে ১০ মণ কম্পোস্ট সার উৎপাদন হয়। এই সার ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কৃষক পরিবার।

একই গ্রামের কৃষানি আলিয়া বেগম জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন তিনি। তার দুইটি চেম্বার থেকে প্রথমবার ১৪-১৫ লিটার লিচেট সংগৃহীত হয়। এটা ফসলে ব্যবহার করে ভালো ফলন পেয়েছেন তিনি। তার ফলন ভালো হওয়ায় এলাকার অন্য কৃষকরা ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও লিচেট কিনে নিয়ে তাদের জমিতে ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও জানান, ছত্রাক দমনে ট্রাইকো-কম্পোস্ট হতে পাওয়া তরল লিচেট কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। আবার উৎপাদিত জৈবসার ব্যবহারে তাদের জমিতে রাসায়নিক সারের পরিমাণ অনেক কম লাগছে। গরুর বর্জ ও বিভিন্ন পচনশীল পদার্থ ব্যবহার করে ট্রাইকো-কম্পোস্ট ও লিচেট উৎপাদনের মাধ্যমে গৃহিনীরা বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। পরিবেশবান্ধব নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ট্রাইকো কম্পোস্ট সারের ব্যবহার আস্তে আস্তে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে কৃষি কর্মকর্তাসহ কৃষক-কৃষানিরা আশা ব্যক্ত করেন।

অন্য এক কৃষক জানান, পানের বরজে ট্রাইকো লিচেট ব্যবহার করে পানের পচন রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে পান পাতার উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে। চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। কৃষকদের জন্য ট্রাইকো কম্পোস্ট একটি কার্যকর এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক জৈবসার। ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করে কৃষকরা একদিকে তাদের ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করছেন, অন্যদিকে উৎপাদন খরচ কমাতে পারছেন।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ জানান, ট্রাইকো কম্পোস্ট একধরনের অতিকার্যকরী জৈবসার, যার মূল উপাদান ট্রাইকোডার্মা নামক একধরনের উপকারী ছত্রাক। বিভিন্ন জৈব উপাদান এবং ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকের অণুবীজ নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশ্রণ করে তা বিশেষ উপায়ে হাউসে জাগ দিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ দিন রেখে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কম্পোস্ট তৈরি করা হয়, সেটাই ট্রাইকো কম্পোস্ট। আর কম্পোস্ট সার তৈরির সময় প্লান্ট থেকে নির্গত তরল নির্যাসই ট্রাইকো লিচেট।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, ট্রাইকোডার্মা হচ্ছে মাটিতে মুক্তভাবে বসবাসকারি উপকারি ছত্রাক। যা উদ্ভিদের শিকড়স্থ মাটি, পচা আবর্জনা ও কম্পোস্ট ইত্যাদিতে অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এটি মাটিতে বসবাসকারি উদ্ভিদের ক্ষতিকর জীবাণু মেরে ফেলে। ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদনে কৃষক দুইদিকে লাভবান হচ্ছেন। প্রথমত, এই জৈবসার জমিতে ব্যবহার করে কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন; অন্যদিকে ট্রাইকো লিচেট ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগবালাই দমনে ব্যবহার করছেন। ফলে কৃষকদের ফসলের রোগবালাই দমনে কীটনাশক ব্যবহারের জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘ট্রাইকো কম্পোস্ট থেকে উৎপাদিত সার ও লিচেট ব্যবহার করে কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছেন। এই প্রযুক্তিটি লাভজনক হওয়ায় সব কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে। তাই ট্রাইকো কম্পোস্ট ও লিচেট উৎপাদন এবং তা ব্যবহারে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত