ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কুয়েট উত্তাল, একাত্মতা প্রকাশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের

‘শাহবাগ ব্লকেড’ ঘোষণা শিক্ষার্থীদের, অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ শিক্ষা উপদেষ্টার
কুয়েট উত্তাল, একাত্মতা প্রকাশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দুই গ্রুপের সংঘর্ষের জেরের ঘটনায় সঠিক বিচার হয়নি, এমনটি দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদকে অপসারণে আল্টিমেটাম দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে, চলমান অস্থিরতা নিরসনে গতকাল রাতে জরুরি বৈঠকে বসেন ভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ। রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বৈঠকের তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে কুয়েট উপাচার্যকে অপসারণের জন্য দেড় ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। দাবি না মানলে রাত ১০টায় শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তারা। ঢাবি শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, কুয়েটের অনশনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থা গুরুতর। কুয়েটকে বাঁচাতে শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করছি। রাতের মধ্যে ভিসি মাসুদ যদি পদত্যাগ না করে অথবা তাকে বহিষ্কার করা না হয় তাহলে এই ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হবে। রাতের এই কর্মসূচিতে ঢাবি, জবি, জাবি, প্রাইভেট, ঢাকা কলেজ, বুয়েটসহ ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেবে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে, কুয়েটের উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন ৩২ জন ছাত্র। ক্যাম্পাসের ‘স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের’ বারান্দায় এ কর্মসূচি শুরু করেন তারা। টানা সাড়ে ২১ ঘণ্টায় আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ে কুয়েটের এমটিই বিভাগের ২৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী। এদিকে গতকাল কুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফোনালাপে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সিআর আবরার কুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উপদেষ্টা খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) আন্দোলন ও অনশনরত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা উষ্ণ আবহাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবং তাদের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে অনশন প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের প্রতি উদ্বেগের কথাও তাদের জানান উপদেষ্টা। উপদেষ্টা আরও আশ্বস্ত করেন শিক্ষার্থীদের দাবি সম্পর্কে সরকার সচেতন রয়েছে। একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল অতি দ্রুত খুলনা যাবে। তারা কুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সমস্যার আশু সমাধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেবে।

কুয়েট শিক্ষার্থীদের একদফা দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল ৫টায় ঢাবি শিক্ষার্থী এবি জোবাইর ও মোসাদ্দেক ইবনে মোহাম্মদের নেতৃত্বে টিএসসিতে এ সংহতি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এসময় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে কিছু সময়ের জন্য শাহবাগ মোড় অবরোধ করে প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন কুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থীরা।

কুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহি বলেন, কুয়েটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। একজন ভিসি কোন পর্যায়ে গেলে শিক্ষার্থীরা তাকে সরানোর জন্য অনশন করছে। নতুন বাংলাদেশে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষার্থীরা তো অনৈতিক কোনো দাবি নিয়ে আসেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জোবাইর বলেন, যদি কুয়েটের ভিসিকে অপসারণ করা না হয়, তাহলে এই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে। আজকে আমরা ৫ মিনিটের জন্য শাহবাগ অবরোধ করেছিলাম। আমরা জনদুর্ভোগ চাই না। তবে যদি আমাদের দাবি মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে দাবি মানাতে যা করতে হয়, আমরা করবো। আমি সরকারকে অনুরোধ করবো- অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে কুয়েটের দলকানা অথর্ব ভিসিকে অব্যাহতি দিন।

কুয়েট শিক্ষার্থীদের উপাচার্যকে অপসারণের এক দফা দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে আসেন শিক্ষার্থীরা। রাজু ভাস্কর্যে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন বিক্ষোভকারীরা। সমাবেশে বুয়েটের শিক্ষার্থী আল ফারাবী বলেন, কুয়েট শিক্ষার্থীদের সকল যৌক্তিক দাবির প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থীরা পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে। আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে দাবি জানাই কুয়েটের শিক্ষার্থীদের দাবি দ্রুত মেনে নিয়ে তাদের অনশন ভঙ্গের ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি প্রকৃত দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। বুয়েটের পাশাপাশি কুয়েট চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং অবিলম্বে কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাদদেশে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ জাবি শাখার আয়োজনে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ছাত্র উপদেষ্টাদেরকে দায়িত্বহীন উল্লেখ করে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই জুলাই গণ?অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে যে প্রশাসন ক্ষমতায় বসেছে, তারা যদি শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব না দেয় তাহলে তারা আর গদিতে থাকতে পারবে না। ছাত্র উপদেষ্টারা বলে তাদের নাকি ক্ষমতা নাই। আমরা স্পষ্টভাবে তাদেরকে বলতে চাই আপনাদের ক্ষমতা না থাকলে নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে না দাঁড়াতে পারলে আপনারা দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ছাত্র উপদেষ্টারা যদি শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াতে না পারে তাহলে ভিসি মাসুদের পদত্যাগের আগে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ চাই। প্রশাসন আমাদের অযুহাত দেয় ভিসি মাসুদ বিএনপির লোক, তার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না।আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলতে চাই, আপনারা যদি বিএনপির কথা শুনেই চলেন তাহলে এখনো ক্ষমতায় বসে আছেন কেন? ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিয়ে দেন, আমরা তাহলে বিএনপির ক্ষমতাবলে চলে যাই। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলতে চাই, আপনারা দ্রুত কুয়েটের উপাচার্যকে অপসারণ করুন।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলার পর তারা বিচারের দাবি জানালো। অথচ কুয়েটের অথর্ব প্রশাসন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করলো। আমরা ফ্যাসিস্ট আমলে দেখেছি বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে হামলার পর প্রশাসন নীরব থাকতো। ফ্যাসিস্টের পতনের পর কুয়েটে একই চিত্র আমরা দেখছি। কুয়েটে এতো বড় ঘটনার পরেও শিক্ষা উপদেষ্টার কোন বক্তব্য নাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোন বক্তব্য নাই। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলতে চাই যে বিপ্লবীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আপনারা ক্ষমতায় বসেছেন, সেই বিপ্লবীদের যদি অনশন করে মরতে হয় তাহলে আপনাদের নরম গদিতে বসে থাকার কোন অধিকার নাই। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই অবিলম্বে কুয়েটের ভিসিকে অপসারণ করতে হবে, নাহলে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবো।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষার্থীরাও একই দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। প্রসঙ্গত, ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়; এতে আহত হন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়। রাতে খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন। গত সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আগামী ২ মে থেকে সব আবাসিক হল শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া ও ৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে গতকাল উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণা দেন কুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত