রাজশাহী বিভাগে গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিভাগটির আট জেলায় দুর্ঘটনার হিসাব তাই বলছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫৯ দিনে ৬২১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৭৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দুর্ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাসড়কের সংজ্ঞার সাথে দেশের মহাসড়কের বাস্তব চিত্র মেলে না। চালকের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। হাইওয়েতে লসিমন করিমন, ভটভট চলাচল ভারি যানবাহন চলাচলের বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া মহাসড়কগুলোর ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ, রোডগুলো দুই লেনের; নেই ডিভাইডার।
প্রতিকার হিসেবে তারা জানান, পুরো হাইওয়ে রোড ডিভাইডারের আওতায় আনা। হাইওয়েতে দ্রুতগতির যান ছাড়া অন্য যানগুলো উঠতে না দেওয়া। চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
জানা গেছে, চলতি বছরে রাজশাহী বিভাগে মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যু-সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ মাসে ৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৯৩ জনের। ২৭ মার্চের রাজশাহীর কাটাখালীতে বাসের সাথে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকা-ে মাইক্রোবাসে থাকা চালক, শিশু-নারী-পুরুষসহ ১৮ জনের আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়। তাদের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। তারা রাজশাহীতে বেড়াতে আসার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এত বড় দুর্ঘটনা রাজশাহীতে এটিই প্রথম। বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের করা তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ‘দ্রুতগতিতে ওভার টেকিং’-এর সময় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে গত ১০ এপ্রিল সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ কাউছার হামিদ জানিয়েছিলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখসহ ১২টি সুপারিশ ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের জানুয়ারিতে ৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে ৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের। এপ্রিলে ৫৬টি দুর্ঘটনায় ৮০ জনের মৃত্যু হয়। মে মাসে ৭৩টি দুর্ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু, জুনে ৩৮ দুর্ঘটনায় ৫৪, জুলাইয়ে ৪১ দুর্ঘটনায় ৬৪, আগস্টে ৪৮ দুর্ঘটনায় ৫৩, সেপ্টেম্বরে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৪৬, অক্টোবরে ৫৭ দুর্ঘটনায় ৫৯, নভেম্বরে ৬২ দুর্ঘটনায় ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ডিসেম্বর মাসের গত ২৪ তারিখ পর্যন্ত ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, মহাসড়কের যে সংজ্ঞা; সেই সংজ্ঞার সাথে দেশের মহাসড়ক মেলে না। আমাদের দেশের মহাসড়কে সবধরনের যানবাহন একসাথে চলাচল করে। এছাড়া চালকের অদক্ষতা, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, পরিবহন শ্রমিকদের অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে ট্রাক ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে। দেখা গেছে, মোটরসাইকেলগুলো সরাসরি যানবাহন বা গাছের সাথে ধাক্কা লেগেছে। এতেও বিপুল হতাহতের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, ১ ডিসেম্বর তানোর ও গোমস্তাপুরে দুজন, ২ ডিসেম্বর নগরীতে একজন ও গোদাগাড়ীতে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়। সাত ডিসেম্বর মান্দায় একজন, ১২ ডিসেম্বর নগরে একজন ছাড়াও গোদাগাড়ী ও চাঁপাই মিলে চারজনের মৃত্যু হয়। ১৩ ডিসেম্বর ঈশ্বরদীতে দুজন, ১৪ ডিসেম্বর নগরীতে একজন, ১৭ ডিসেম্বর নাটোর ও পুঠিয়ায় দুজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০ ডিসেম্বর পুঠিয়ায় একজন ও নওগাঁয় দুজন, ২১ ডিসেম্বর পবায় একজন, ২৪ ডিসেম্বর গোদাগাড়ীতে একজনের মৃত্যু হয়।
ট্রাকচালক রুবেল হোসেন জানান, ‘রাতে ঘুমের চাপে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া কোচগুলো (বাস) বেপরোয়া গাতিতে চলাচল করে। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এছাড়া হাইওয়েতে লসিমন করিমন, ভটভট, সাইকেল ও মোটরসাইকেল একই সঙ্গে চলে। এ চালকদের অদক্ষতার কারণে তারা সিগনাল বোঝে না। কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত সড়ক পারাপারের চেষ্টাকালে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে।’ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ রাজশাহী জেলা সহ-সভাপতি ওয়ালিউর রহমান বাবু জানান, ‘দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা চালক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি পালন করি। লিফলেট বিতরণ করি। রাজশাহী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক টিটো জানান, দুর্ঘটনার অনেক কারণÑ এর মধ্যে অসাবধানতাবশত ওভারটেকিং উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রোডগুলো দুই লেনের; ডিভাইডার নেই, চালকদের অদক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে অদক্ষ চালকের কারণে। এছাড়া সড়কে বসে হাটবাজার। এটিও দুর্ঘটনার বড় কারণ। প্রতিকার হিসেবে তিনি বলেন, পুরো হাইওয়ে ডিভাইডারের আওতায় আনা গেলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। এছাড়া হাইওয়েতে দ্রুতগতির যান ছাড়া অন্য যান ঢুকতে দেওয়া যাবে না। চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করতে হবে।