নারায়ণগঞ্জে হাজীগঞ্জ দুর্গের উন্নয়নে বাধা ১১ শিল্পপতি

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শরীফ সুমন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ কেল্লা বা হাজীগঞ্জ দুর্গকে পর্যটন কেন্দ্র করার প্রস্তাব দিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক)। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও। সোয়া ৩ বছর আগে এই দুর্গের চারপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে পর্যটন কেন্দ্র করার কথা থাকলেও প্রভাবশালী ১১ কারখানার মালিকপক্ষের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। উচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আটকে রয়েছে প্রকল্পটির উন্নয়ন কাজ ।

জানা গেছে, নাসিকের ১১নং ওয়ার্ডের হাজীগঞ্জ এলাকায় ‘হাজীগঞ্জ দুর্গ’ মুঘল আমলে নির্মিত একটি জল দুর্গ। এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। ঢাকা শহরকে রক্ষা করতে সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভুজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গাল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৫৮০ সালে মোঘল সুবেদার মীর জুমলার শাসনামলে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে হাজীগঞ্জ দুর্গ নির্মাণ করা হয়। তবে কালের বিবর্তনে এর অনেক প্রাচীন স্থাপনা ভেঙে গেছে। হাজীগঞ্জ দুর্গটি বহুকাল পরিত্যক্ত থাকায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। একটি মহল দুর্গটি দখলের চেষ্টাও করে। অপর একটি অংশ চানপুকুর দখল করে সেখানে প্রভাবশালীরা মিল-কারখানা গড়ে তোলে। 

এদিকে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর হাজীগঞ্জ দুর্গটির আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা প্রায় অর্ধশত অবৈধ স্থাপনায় সমন্বিতভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। অভিযানে বড় বড় প্রায় ১২টি গোডাউন তিনটি ভেকু দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

এরপর ওই বছরের ৩ নভেম্বর পরিদর্শনকালে হাজীগঞ্জ দুর্গকে সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী কেএম খালিদ জানান, আদালতের নির্দেশে গেলো সপ্তাহে উচ্ছেদের মাধ্যমে দুর্গের আশপাশের অবৈধ দখল থেকে অবমুক্ত হওয়া কয়েক একর জমিতে নাসিকের সহযোগিতায় বাগান নির্মাণ ও আলোকসজ্জাসহ নানাভাবে সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংস্কারের মাধ্যমে দর্শনীয় স্থানের উপযোগী করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলে সর্বসাধারণের বিনোদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেবে। সে সময় নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বন্যাকবলিত এলাকায় উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পাট সংরক্ষণের জন্য দুর্গের আশপাশের জমিটি তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা থেকে পাট মন্ত্রণালয় লীজ নিয়ে বেশ কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করেছিল। পরবর্তীতে গুদামগুলোসহ পুরো জমিটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে চলে যায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এই জায়গা অবৈধভাবে দখল করে সেখানে গড়ে ওঠে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের মিল কারখানা ও গুদামঘর। মেয়র আইভী আরো জানান, বর্তমানে পাট মন্ত্রণালয়ের এই জায়গার প্রয়োজন না থাকায় সিটি করপোরেশন এই ভূমি ফেরত নেয়ার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করলে সিটি করপোরেশনের অনুকূলে রায় আসে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে জমিটি উদ্ধার করতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। সেই আলোকে জমিটি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান মেয়র আইভী। তিনি বলেন, আমি হাজীগঞ্জ কেল্লা সংরক্ষণ করতে চাই। এখানে মাঠ করে ফুলের বাগান করে দিতে চাই। মানুষ যেন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে।

এদিকে এর কিছুদিন পরই হাজীগঞ্জ দুর্গের পাশের সম্পত্তিগুলো নিজেদের ক্রয়কৃত সম্পত্তি দাবি করে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে স্ট্যাটাসকো অর্ডার (স্থিতাবস্থা) এনে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছিল ১১টি প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞপ্তি শিরোনাম দিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের স্ট্যাটাসকো অর্ডার (স্থিতাবস্থা) উল্লেখিত ব্যানারে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা ছিল সেগুলো হলো, মেসার্স রকি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মেসার্স ব্রাইট প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স  সোনালী ডাইং অ্যান্ড প্যাকেজিং মিলস, মেসার্স রাসেল নিটিং, মেসার্স আনোয়ারা অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স আশরাফ টেক্সটাইল প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স বিসমিল্লাহ ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং মিলস, মেসার্স নিলিমা কটন প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স রাসেল ওয়াশিং প্ল্যান্ট, মেসার্স এমআর নিটিং মিলস (প্রাঃ) লিঃ ও মেসার্স আজমিরী  ট্রেডার্স।

এদিকে আদালতের স্ট্যাটাসকো অর্ডারের কারণে ৩ বছরের বেশি সময় ধরেই বন্ধ রয়েছে হাজীগঞ্জ দুর্গকে পর্যটনে রূপান্তরের পরিকল্পনা। তবে ৩ বছর পরে গত ৫ জানুয়ারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল নারায়ণগঞ্জে এসেছিল। ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে। তারা সারা দিন নগরীর  কিল্লারপুল এলাকায় অবস্থিত বিবি মরিয়মের সমাধি সৌধ, পাশেই হাজীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত হাজীগঞ্জ দুর্গ বা কেল্লা এবং বন্দরে সোনাকান্দা কেল্লা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধিদলটি অবাক হন বিবি মরিয়মের সমাধি সৌধ দেখে। কতটা অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ।

হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখে প্রত্নতত্ত্বের মহাপরিচালকসহ সবাই অবাক হন। চাইলেই এটাকে পার্ক বানানো যায়। খেলার মাঠ তো এক প্রকার তৈরিই আছে। শুধু আশপাশের জায়গায় কিছু অবৈধ দখলদার ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে টিম সদস্যরা রাস্তাটির প্রশংসা করেছেন। বিকালে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন প্রত্নতত্ত্বের টিম সদস্যরা। সাক্ষাৎকালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে নাসিক মেয়রের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ ও পুরাকীর্তির সংস্কার ও সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে প্রত্নতত্ত্ব অদিদপ্তর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন একযোগে কাজ করবে। মেয়র আইভী এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। আলোচনা শেষে নাসিক কর্তৃপক্ষ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানই একমত পোষণ করেন। এদিকে এখনো দুর্গটি অরক্ষিত রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই কেল্লার ভেতর ও বাইরে নেশাখোর, জুয়াড়ি ও মাদক বিক্রেতাদের আড্ডাস্থল রয়ে গেছে। দিনের বেলায় মানুষের আনাগোনা দেখা গেলেও সন্ধ্যার পরে ভয়ে কেউ কেল্লায় প্রবেশ করে না। সন্ধ্যার পরে মূলত কেল্লাটি হয়ে ওঠে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। যারা প্রতিনিয়ত কেল্লা ও আশপাশের এলাকাকে বিষাক্ত করে তুলছে। এলাকাবাসীর দাবি, অচিরেই যেন ঐতিহাসিক এই দুর্গটি রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি সৌন্দয্য বর্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। যাতে করে হাজীগঞ্জ দুর্গের পুরোনো ঐহিত্য ফিরে আসে। এ বিষয়ে নাসিকের ১১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অহিদুল ইসলাম ছক্কু বলেন, হাজীগঞ্জ দুর্গ ও এর ভেতরের খেলার মাঠের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে।