দুই বছরেও শুরু হয়নি নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামের কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমভি সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চডুবিতে ৩৪ জন নিহতের মামলার বিচারকাজ। ওই ঘটনায় তখন গ্রেপ্তার ১৪ আসামির মধ্যে ১১ জনকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। অপরদিকে গত বছরের মার্চে একই স্থানে অপর একটি লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায়ও মামলা করা হয়েছিল। ওই মামলায়ও পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। তবে আজও ওই মামলারও বিচার শুরু হয়নি। এ ছাড়া নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি যথাক্রমে ২৩টি ও ২১টি সুপারিশ করলেও অদ্যাবধি সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অদ্যাবধি তদন্ত কমিটির ওই ২৩ সুপারিশের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল বিকেলে ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে এমভি সাবিত আল হাসান লঞ্চ মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ৬টা ১৫ মিনিটে লঞ্চটি শহরের কয়লাঘাট এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু অতিক্রম করার সময় পেছন থেকে এসকেএল-৩ কার্গো ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেয়। এতে লঞ্চের কিছু যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও ২ শিশু, ১৭ নারীসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার দিন রাতে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা করা হয়। ঘটনার রাতে জেলা প্রশাসনের ৭ সদস্য ও বিআইডব্লিউটিএর ৫ সদস্যের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আরও একটি ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ১০ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া এলাকায় মেঘনা নদী থেকে ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামে কার্গো জাহাজটিসহ এর মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানি ও লস্কর ১৪ জনকে আটক করে কোস্টগার্ডের সদস্যরা। ওই দুর্ঘটনার পরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা প্রশাসনের পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে ২৩টি ও ২১টি সুপারিশ প্রস্তাবনা করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে সেসব সুপারিশের কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। কার্গো জাহাজের বেপরোয়া গতি ও নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর ত্রুটিপূর্ণ নকশাকে দায়ী করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে নদীর মাঝখানে নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর পিলার স্থাপন করা এবং নৌপথে প্রতিবন্ধকতামূলক নির্মাণসামগ্রী রেখে নৌপথ সরু করে ফেলাকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনেও কার্গো জাহাজের বেপরোয়া গতি, চালকের উদাসীনতায় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেই তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো ধরনের কার্র্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে একই এলাকায় আরো একটি লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে।
২০২২ সালের ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী নিয়ে এমভি আফসার উদ্দিন নামে যাত্রীবাহী লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ২টা ২০ মিনিটে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় পৌঁছলে পেছন থেকে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন এম এল রূপসী ৯ নামে একটি পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেয়। এ সময় নদীতে লাফিয়ে পড়ে অধিকাংশ যাত্রী তীরে উঠলেও নারী ও শিশুসহ ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনাতেও বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ওই লঞ্চ ডুবির ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিআইডব্লিউটিএ) ড. আ. ন. ম বজলুর রশিদকে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (সার্বিক) প্রধান করে ৬ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করা হয়।
২০২২ সালের ২০ মার্চ লঞ্চডুবির ঘটনার পরে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৭টি রুটে চলাচলকারী ৭০টি লোয়ার ডেকের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৩৪ দিন বন্ধ থাকার পর ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে যাত্রী সাধারণের চলাচলের স্বার্থে প্রাথমিকভাবে ১৮টি লঞ্চ চালু করা হয়। পর্যায়ক্রমে ৪৯টি লঞ্চের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এসব লঞ্চ চলাচলের জন্য কিছু শর্তাবলি জুড়ে দিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। যার মধ্যে ছিল সানকেন (নিচু) ডেক বিশিষ্ট নৌযানের স্থলে হাইডেক বিশিষ্ট নৌযান প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারকৃত লঞ্চগুলো নির্দিষ্ট লেইনে চলাচল এবং সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারকৃত প্রত্যেকটি লঞ্চে চলাচলের পূর্বে বাধ্যতামূলতভাবে ভিএইচএফ সংযোজন, সার্ভে সনদে উল্লেখিত মাস্টার ও ড্রাইভার দ্বারা লঞ্চ পরিচালনা করা এবং সার্ভে সনদে উল্লেখিত সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদি লঞ্চের বা নৌযানের যথাস্থানে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। গেল বছরের ১২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের চলাচলের স্বার্থ বিবেচনা করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫টি রুটে ৪৯টি সানকেন (নিচু) ডেকের লঞ্চকে চলাচলের অনুমতি দেয়া হলেও আগামী বছরের পর অর্থাৎ ২০২৩ সালের পর থেকে নারায়ণগঞ্জে চলতে পারবে না কোনো সানকেন (নিচু) ডেকের লঞ্চ। লঞ্চের মালিককে তাদের লঞ্চগুলোকে হাই ডেকে পরিণত করতে হবে। অন্যথায় এসব লঞ্চ নারায়ণগঞ্জ থেকে চলাচল করতে পারবে না।
বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপপরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য বলেন, মামলা দুটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। দুটি মামলার বাদী আমি, তবে এখনো সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে আদালতের কোনো নোটিশ পাইনি। সানকেন (নিচু) ডেকের লঞ্চের মালিকদের কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।