ঢাকা ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রংপুর অঞ্চলে তীব্র দাবদাহ

হাঁসফাঁস করছে মানুষের জীবন ফেটে চৌচির ফসলি জমি

হাঁসফাঁস করছে মানুষের জীবন ফেটে চৌচির ফসলি জমি

রংপুর অঞ্চলে চলমান দাবদাহে হাঁসফাঁস করছে মানুষের জীবন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রংপুরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে একই সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে ১৩০ মিলিমিটারেরও বেশি। অথচ রংপুর অঞ্চলে এপ্রিলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৮০ থেকে ৯০ মিলিমিটার। চলমান তাপপ্রবাহে মানুষের জীবন স্থবির হয়েছে। এতে নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন। চলার পথে একটুখানি ছায়া পেলে জিরিয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন, জলাধারগুলো শুকিয়ে যাওয়া, দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে জলীয় বাষ্প না আসা, অধিক হারে পরিবেশ দূষণকারী ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ, অবাধে বৃক্ষ নিধন। এছাড়া কালবৈশাখি ঝড় না হওয়ায় প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতিতে মানুষের পাশাপাশি পশুপাখি ও কৃষিতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিলে রংপুর অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৮০ থেকে ৯০ মিলিমিটার। সেখানে গত এক মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৪৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। স্বাভাবিকের অর্ধেক বৃষ্টিপাত হয়েছে। অপরদিকে গত বছরের এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। গত বছর এপ্রিলে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১৭৯ মিলিমিটার। ওই মাসে গড়ে ১৫ দিন বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এবার মাত্র দুই দিন বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া গত বছরের এপ্রিলে রংপুরে ৩৩ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। এবার ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা উঠেছিল।

গত বছর শুধু অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতই নয়, দুইবার ৭০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে রংপুর অঞ্চলে। এবার ঝড়-বৃষ্টির দেখা নেই বললেই চলে। এদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় খরতাপের কারণে অনেক স্থানের চাষিদের সেচ দিয়ে ফসল রক্ষা করতে হয়েছে। এতে কৃষকদের বাড়তি খরচের মুখোমুখি হতে হয়েছে। উত্তরের জেলা রংপুরেও চলমান তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস করছে মানুষের জীবন। এতে নাভিশ্বাস হয়ে উঠছে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন। চলার পথে একটুখানি ছায়া পেলে জিরিয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ।

জানতে চাইলে রিকশাচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছর মে মাসে রোদের বেশি তাপ। হাঁসফাঁস অবস্থা সবার। তবুও জীবিকার তাগিদে তীব্র রোদে কাজ করতে নামতে হচ্ছে। আরেক রিকশাচালক মধু মিয়া বলেন, বাইরে বেশি তাপের কারণে মানুষ বের হয় না, কয়েকদিন থেকে শহর ফাঁকা, এজন্য আয়-রোজগার কমে গেছে। নগরবাসী বলছে, প্রচণ্ড গরমে অস্থির তারা। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় দিন কাটছে তাদের। নগরীর সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী আমান উদ্দিন বলেন, রংপুরে একে তো যানজট পেরিয়ে মার্কেটে এসেছি তারপরও তাপ, ভ্যাপসা গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। কামার পাড়ার ব্যবসায়ী তারিফ বলেন, এমনি গরম তারপর আবার লোডশেডিং- এ কারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছি। এমনি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা হালকা মানুষের শক মরে গেছে তারপর গরম আবার লোডশেডিং। মিঠাপুকুর উপজেলার বুজরুক হরিপুর গ্রামের মৎস্য চাষি মো. বুবেল মিয়া জানান, এক একর জমিতে চাষ করেন। কিন্তু পানি না থাকায় পুকুরে মাছ চাষ করতে পারছেন না। তিনি বলেন, স্যালো মেশিনে নিচ থেকে পানি উঠে না। তাই পুকুরে মাছ চাষ করা হচ্ছে না। তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। একই গ্রামের বর্গাচাষি মো. খয়বার হোসেন একবিঘা জমিতে ধান রোপণের জন্য ধানের বীজতলা তৈরি করেছেন। কিন্তু ওই বীজতলা তীব্র খরতাপে পুড়ে গেছে। এখন তিনি ধান রোপণ করতে পারছেন না।

কলেজশিক্ষার্থী রওনক বলেন, এবার যে পরিমাণ গরম পড়েছে তা আগের যে কোনো বছরের গরমকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়। আমরা বৃষ্টির প্রতিক্ষায় আছি। এদিকে সুখবর নেই, উল্টো আরো বেশ কয়েক দিন এমন পরিস্থিতির আভাসই দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গতকাল শুক্রবার রংপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড-৩৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজার হাট-৩৫.৮, দিনাজপুর-৩৬, ৫, সৈয়দপুর-৩৭.৩, ডিমলা-৩৭.২, তেঁতুলিয়া-৩৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরো বেশ কয়েকদিন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করবে।

এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ব্রয়লার মুরগির হিট স্ট্রোক হচ্ছে তাই বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কমে গেছে। বাজারে বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির কেজি

১৭০-১৮০ টাকা। কমার কারণ জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে হিট স্ট্রোক হয়ে মুরগি মারা যাচ্ছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে সেল দিতে হচ্ছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদী ও জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন হওয়ায় আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে আসছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে রংপুরের মিঠাপুকুর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে শত শত নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। কয়েক হাজার নলকূপে পানি উঠছে একেবারেই কম। এতে বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা।

তিনি আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। তিনি আরো বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনসহ নানা কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে চাষাবাদে তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষক। প্রথমত সেচে বাড়তি খরচ, দ্বিতীয়ত জমিতে আগাছা, রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং তৃতীয়ত উৎপাদিত ধানে ভালো মানের চাল না পাওয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত