বর্ষার শুরুতেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ বরিশাল নগরীর বাসিন্দারা। অবস্থা এমন যে শুধু রাতে নয়, দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে। তবে এ অবস্থায়ও মশক নিধনে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকায় দিন দিন মশা বাড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। মশা নিধনে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছে নগরবাসী।
নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড রূপাতলী হাউজিং এলাকার ২৫ নম্বর রোডের বাসিন্দা হেমায়েত ইসলাম বলেন, ছয়তলায় একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকি। মশার উৎপাত এতই বেশি যে সন্ধ্যার পর সন্তানদের মশারির মধ্যে রাখতে হয়। মশার জ্বালায় বাসায় কোথাও একটানা বসে থাকা যায় না। মশার কামড়ে স্বাভাবিক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মশা মারতে করপোরেশনের লোকজনের দেখা মেলে না। তিনি বলেন, নগরীর অন্য এলাকার তুলনায় এটি নিম্নাঞ্চল। সারাবছরই এ ওয়ার্ডে পানি জমে থাকে। এর মধ্যে নতুন নতুন বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। এছাড়া রূপাতলী হাউজিং এলাকার পাশেই বাস টার্মিনাল। যে কারণে টায়ার-টিউবসহ অন্য যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। টার্মিনালের রাস্তার দুই পাশের ড্রেন ও নালায় অসংখ্য প্লাস্টিকের কাপ, পানির বোতল, ককশিটের বাক্স, ডাবের খোসা, ঠোঙা জমে আছে। এখানে প্রচুর মশা জন্মায়। কিন্তু এ এলাকায় সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটায় না।
নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নতুনবাজার কালীমন্দির গলির বাসিন্দা স্বপন দাস বলেন, নতুনবাজার হলো মশার কারখানা। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হলে মশা যেভাবে ঘিরে ধরে মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দিনেও মশা কামড়ায়। ২৪ ঘণ্টা কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বাচ্চাদের মশারির মধ্যেই রাখতে হয়।
নগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ডের অক্সফোর্ড মিশন রোডের বাসিন্দা টিপু শিকদার বলেন, আগে দেখতাম সন্ধ্যা হলে মশার উৎপাত শুরু হয়। এখন দিন-রাত সমান তালে মশার যন্ত্রণা। তবে সন্ধ্যার পর তা চরমে পৌঁছে। সন্ধ্যার পর কয়েল বা স্প্রে ছাড়া ঘরে থাকা যায় না। এরপরও মশক নিধনের কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না।
তিনি আরো বলেন, চলছে বর্ষা মৌসুম। বৃষ্টি হলে এডিস মশা বাড়বে। আবার গরমে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলেও মশা বাড়বে। তাতে ডেঙ্গুর প্রকোপও বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। সাধারণত জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এ সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম বলা হয়। তবে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, তা মশা মারতে কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি শাহ সাজেদা বলেন, নগরীর সবখানেই মশার উৎপাত। সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম চললেও মশা কমছে না। মশা নির্মূলে আগাম ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি নিয়মিত ট্যাক্স দিই। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া আমার অধিকার। সে জায়গা থেকে মশার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনার দাবি জানাচ্ছি।
বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) সূত্রে জানা গেছে, ৫৮ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল সিটিতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বাস। ৩০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত এ সিটির মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন মাত্র ১০০ কর্মচারী। আধুনিক সরঞ্জাম বলতে রয়েছে ১১টি ফগার মেশিন। আর রয়েছে ৮০টির মতো হস্তচালিত স্প্রে মেশিন। তবে যারা এসব পরিচালনা করছেন, তাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। ফলে তারা জানেন না কোথায় কোনো প্রজাতির মশা রয়েছে। কোনো মশার জন্য কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। আর কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা কতটুকু।
বরিশাল সিটির পরিচ্ছন্নতা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, মশকনিধনে আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে কাজ করছি। প্রতিদিন প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি টিম মশার লার্ভা শনাক্তে কাজ করে। লার্ভা শনাক্ত হলে সেখানে হ্যান্ড স্প্রে ব্যবহার করে লার্ভা ধ্বংস করা হয়। এছাড়া বিকেলে ফগার মেশিন দিয়ে মশকনিধনে স্প্রে করা হয়। তিনি আরো বলেন, এডিস মশার লার্ভা শনাক্তে বরিশালে কোনো ল্যাব নেই। যে কারণে যেখানে যে ধরনের লার্ভাই পাওয়া যাক সেগুলো ধ্বংস করা হয়। দিনে পাঁচটি টিম ফগার মেশিন দিয়ে এবং ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটি টিম লার্ভা ধ্বংস করতে হ্যান্ড স্প্রে নিয়ে অভিযান চালায়।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খন্দকার মনজুরুল ইমাম বলেন, গত দুই বছর বরিশালে ডেঙ্গুর তেমন প্রকোপ ছিল না। এজন্য আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর) থেকেও কোনো প্রতিনিধি এ বছর আসেনি। গত দুই বছর যারা এসেছেন তারা বরিশালে এডিসের লার্ভা পাননি। এখন পর্যন্ত যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই ট্রাভেল পেশেন্ট। আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায়। ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। সেখান থেকে অন্যরা সংক্রমিত হয়েছেন।
সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, মশকনিধন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। নগরীর খাল, ড্রেন, জলাশয়, ডোবা, নালা, নর্দমা পরিষ্কার করা হচ্ছে। খাল পুনঃখননের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মশার উপদ্রব আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।