হকারের দখলে বাহাদুর শাহ পার্ক
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী পার্কটি। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়মিত শারীরিক কসরত করেন। বিকাল থেকে রাত অবধি চলে ব্যায়ামের কার্যক্রম। পার্কের চারপাশ ঘিরে রয়েছে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি বিদ্যাপীঠ। সৌন্দর্য রক্ষার্থে ২০২০ সালে ঐতিহ্যবাহী পার্কটি সাজানো হয় নতুন আঙ্গিকে। বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে সংস্কারের মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আধুনিকায়ন করলেও পার্কটি অনেকটা গিলে খাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পার্কটি ঘিরে গড়ে উঠেছে ক্যাফেসহ ছোট-বড় বিভিন্ন ফলের দোকান।
এসব দোকানের কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে পার্কের পরিধি। এছাড়া ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকায় সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পার্কটির। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের স্বস্তি খোঁজার এই পার্কটির চারপাশে আগে লোহার রেলিং থাকায় ভেতরে নির্ধারিত সময়ের আগে কেউ ঢুকতে পারতেন না। বিশেষ করে আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষার্থী এখনকার মতো তখন দিনভর পার্কে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পেত না। পার্কের মধ্যে ডেন্ডিখোররা অবস্থান নিতে পারত না। কিন্তু সংস্কার করার পর রেলিং তুলে দেওয়ায় এখন চারিদিক খোলা। পার্কের উত্তর দিকে হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। পথচারী, ডেন্ডিখোর আর পরিবহণ শ্রমিকদের মলমূত্র ত্যাগ করায় এই পাশে নাক চেপেও চলা যায় না।
দুই দিন পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, পূর্ব পাশের গেটের উত্তর পাশে মূল সড়কে তিনটি চায়ের দোকান অনেকটা স্থায়ীভাবে বসানো হয়েছে। গেটের দক্ষিণ পাশে একজন ডাব বিক্রেতা বহুবছর ধরে দোকান করছেন। সম্প্রতি ভাত, খিচুড়ি বিক্রি করেন তিনজন। চা-রুটি, কলার দোকান দিয়েছেন তিনজন। কিছুদিন আগে নতুন করে বসেছেন একজন লেবুর শরবত বিক্রেতা। এদের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে পার্কে ঢোকার সুযোগ থাকলেও পুরো পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ দিকে পার্কের ফুটপাতে পান-সিগারেট বিক্রেতা, আখের রসের দোকান যেন গেড়ে বসেছে। কেউ চাইলে ওই পথ দিয়েও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবেন না। অন্যদিকে পার্কের পশ্চিম পাশের ফুটপাত যেন ফল বিক্রেতারা স্থায়ী হিসেবে দখল করে নিয়েছেন। কমপক্ষে ২০ জন বিক্রেতা নিয়মিত সকাল থেকে রাতভর দোকান করায় মানুষকে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বছরের পর বছর এমনটা চলে এলেও দেখার যেন কেউ নেই। শুধু তাই নয়, এসব দোকানিরা অবৈধভাবে বিদ্যুতও ব্যবহার করছেন।
জানা যায়, বাহাদুর শাহ পার্কে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফুড কোর্ট নির্মাণের অনুমতি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির কাছ থেকে ৩ কোটি ৬১ লাখ টাকায় ২০২৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পার্কটি ইজারা নেয় ডিএআর হোল্ডিং লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটি। এর বিরোধিতা করে স্থানীয়রা। ক্ষুব্ধ স্থানীয়দের মতে, ক্যাফেটি যে জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে তাতে পার্কের জায়গা ও এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সংকুচিত হয়েছে। চুক্তিতে সংস্থাটিকে এক বছর পার্কে একটি ফুড কোর্ট চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এই শর্ত ভঙ্গ করে সম্প্রতি পার্কের ভেতর ২টি ক্যাফে স্থাপন করা হয়েছে।
গত সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পার্কটির ভেতরে দক্ষিণ দিকে স্টিলের অবকাঠামোর ওপর একটি ঘর রয়েছে। ঘরের ভেতরে তিনটি কক্ষ, মেঝেতে টাইলস বসানো। এসব কক্ষ গুদাম ও রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর পার্কের উত্তর দিকে টিন ও কাঠের আরেকটি অবকাঠামো তৈরি করে সেখানে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। ইজারাদার পার্ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন বলে শর্ত দেওয়া হলেও পার্কের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেখতে পাওয়া যায়। পার্কটিতে ক্যাফে বসানোর পর বাণিজ্য আগে থেকে বেড়ে গেছে। পার্কটির পশ্চিম পাশে কোল ছুঁয়ে ফল ব্যবসায়ীরা দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন ব্যবসায়ী ফুটপাত দখল করে ফলের দোকান বসানোয় পথচারীদের চলাচলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া হরেকরকম ফেরিওয়ালারা তাদের জিনিসপত্র বিক্রির সময় উচ্ছিষ্ট অংশ পার্কেই ফেলে রাখায় দূষণ বেড়েছে।
এসব কারণে দিন দিন পার্কটি তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। লক্ষ্মীবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা শরিফ বেগম বলেন, ‘রক্ষণাবেক্ষণের নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই পার্কের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ হোসাইন মোহাম্মদ নামে একজন বলেন, আগে মানুষ এখানে এসে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারত। এখন মানুষের আওয়াজে এখানে বসা যায় না। দিন দিন হকারদের অবস্থান বেড়ে যাচ্ছে যার ফলে পার্ক এখন তার শ্রী হারাতে বসেছে। পার্কে আসা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব সকালে এবং সন্ধ্যা হলেই বেড়ে যায় ছিনতাই। পার্কে আশ্রয় নেওয়া ভবঘুরে প্রায় অর্ধশতাধিক নানা বয়সি ছেলেমেয়ে এই অপরাধের মূলহোতা। বাহাদুর শাহ পার্ক ও ঐতিহ্য রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব মো. আখতারুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে পার্কে এ ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনার কোনো প্রয়োজন আছে। এটি শুধু ঐতিহাসিক স্থানের সৌন্দর্যই নষ্ট করছে না, তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা থেকেও স্থানীয়দেরও বঞ্চিত করছে।’ পার্কে ছিনতাই-চাঁদাবাজির বিষয়ে অবগত নয় বলে দাবি করেছে পাশের সূত্রাপুর থানা পুলিশ। সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুল ইসলাম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে পার্কের সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। ড্যান্ডিখোরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছি। চাঁদাবাজির বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে না। এরকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।