‘অবিরত লোকসান’ থেকে বাঁচতে রোটেশন চালু করে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেছেন ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের লঞ্চ মালিকরা। এ পদ্ধতিতে পাঁচটির পরিবর্তে মাত্র দুটি লঞ্চ বরিশাল নৌবন্দর ছেড়ে যাওয়ায় টিকিট হয়ে গেছে ‘সোনার হরিণ’। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীচাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সব শ্রেণির যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। ফলে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে চালু হওয়া রোটেশনের ভোগান্তিতে যাত্রী সংখ্যা আরো হ্রাসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে দ্রুত দুর্ভোগ কমিয়ে শতভাগ সেবা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে যাত্রীরা।
তথ্য মতে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের প্রতিদিন দুই প্রান্ত থেকে উপচেপড়া যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন ৭-৮টি করে লঞ্চ চলাচল করত। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সড়ক পথে দুর্ভোগ কমে যাওয়ায় লঞ্চে যাত্রী কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এছাড়াও একাধিকবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে লঞ্চ মালিকরা ‘লোকসানে’ রয়েছে। চলতি বছরের ২৬ আগস্ট রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ পরিচালনা করার আগে বিলাসবহুল ছোট লঞ্চের (৩০০ ফুটের নিচে) একটি ট্রিপে লোকসান হতো এক থেকে দেড় লাখ টাকা। একই সময়ে বড় লঞ্চ এক ট্রিপে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিত বলে দাবি লঞ্চ মালিকদের।
এ রোটেশনের ফলে বর্তমানে লঞ্চ সংখ্যা কমে যাওয়ায় লঞ্চের টিকিট সংগ্রহে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে যাত্রীরা। এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে নৌবন্দরে গিয়েও অধিক দামে টিকিট কিনতে ব্যর্থ হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। লঞ্চের ডেকেও যাত্রী ভোগান্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। অধিকাংশ দিন লঞ্চের প্রথমশ্রেণির বারান্দায়ও ডেকের যাত্রীরা অবস্থান করছে। ফলে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের উদ্দেশ্যে লঞ্চে উঠে যাত্রীরা ভোগান্তিবিহীন গন্তব্যে ফিরতে পারছে না। শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ৫০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতো। ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত জরিপের ফল অনুযায়ী প্রতিদিনের সেই যাত্রী সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজারে। এই এক বছরে ১৭ হাজার যাত্রী হ্রাস পেয়েছে। যাত্রী হ্রাসের শতকরা হারে যা ৩৪ ভাগ।’ নিয়মিত যাতায়াতকারী ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, ঢাকায় যাওয়ার জন্য লঞ্চের একাধিক কাউন্টারের মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পেয়েছি। তাই স্বশরীরে টিকিট কাউন্টার এসেও কিনতে পারিনি। যে লঞ্চের অফিসেই যাই তারাই বলেন, ‘তাদের লঞ্চ নেই’। যে দুটো লঞ্চ চলছে তাতেও কোনো কেবিন খালি নেই। এতো ভোগান্তির পরও টিকিট পাইনি, এখন লঞ্চের ডেকে শুয়েও তো যেতে পারব না। তাছাড়া রাত ১০টার পর লঞ্চের কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। কোনো বিপদে পড়লে লঞ্চের কারও সাহায্য নেবো সেই উপায় নেই। লঞ্চের ডেক যাত্রী মোকলেস মিয়া জানান, মাত্র ৩০০ টাকায় আরামে ঢাকায় যেতে লঞ্চে উঠছি। কিন্তু লঞ্চ কমে যাওয়ায় ডেকে যাত্রী বেশি উঠেছে। আগের মতো শান্তিতে যেতে পারব না। লঞ্চে যদি শান্তি না পাই তাহলে ৯-১০ ঘণ্টায় কেনো ঢাকায় যাব? অবিলম্বে যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি। বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, সর্বোচ্চ যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে নৌপথের এই সার্ভিস টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। তাই লোকসান এড়াতে সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে যাত্রী আকর্ষণে নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার পরিচালক ও অ্যাডভেঞ্জার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন মৃধা জানান, অব্যাহত লোকসান থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে রোটেশনে লঞ্চ চলছে। বর্তমানে প্রতি ট্রিপে লোকসান না হলেও সমান সমান অবস্থায় টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছি। জ্বালানিসহ সব খরচ বৃদ্ধির কারণে লঞ্চ শিল্প ধূলিসাৎ (ধুলায় পরিণত) হয়ে যাচ্ছে। লঞ্চ মালিক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, প্রতিনিয়ত সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চলছে। আমরা সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।