ওভারব্রিজের পিলার, অলিগলি, ল্যাম্প পোস্ট ও দেওয়ালসহ সর্বত্রই পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো রাজধানী। চোখ মেললেই দেখা মেলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় টু-লেট, বিভিন্ন ব্যক্তির প্রচারণামূলক পোস্টার, বিজ্ঞপ্তি আর ব্যানারের ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বেহাল অবস্থা ফ্লাইওভারগুলোর। রাজধানীর ফ্লাইওভার মানেই যেন বিজ্ঞাপনদাতাদের ‘স্বর্গরাজ্য’। সুযোগ পেলেই ফ্লাইওভারের যত্রতত্র লাগানো হচ্ছে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন। ফলে নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্য। রাজধানীর এমন কোনো ফ্লাইওভার নেই যার পিলার এবং ওয়ালে পোস্টার, ব্যানার ও বিজ্ঞাপন নেই। এমনকি ফ্লাইওভারের উপরেও দেখা যায় নানা বিজ্ঞাপন। যদিও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ফ্লাইওভারগুলোতে পোস্টার লাগানোতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও কে শোনে কার কথা! ব্যক্তি পর্যায়ের ছবি সম্মিলিত পোস্টার ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার, হাসপাতাল ও দোকানের বিজ্ঞাপনী পোস্টারে সয়লাব রাজধানীর সব ফ্লাইওভার। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের পিলার ও ওয়ালজুড়ে শুধু পোস্টার আর পোস্টার। বিশেষ করে মালিবাগ, মৌচাক এবং মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে পিলার ও ওয়ালে সবচেয়ে বেশি পোস্টার আর বিজ্ঞাপনি ব্যানার। এছাড়া মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভারে ব্যানার, বিজ্ঞাপন ও পোস্টার রয়েছে। যত্রতত্র লাগানো এসব পোস্টার সরিয়ে ফেলার দাবিও জানাচ্ছেন পথচারীরা। সেইসঙ্গে ফ্লাইওভারের উপরে থাকা ব্যানার-পোস্টারে গাড়িচালকদের দৃষ্টি সেদিকে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে অভিযোগ চালকদের। রাজধানীর মালিবাগ অংশের ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী পথচারীরা বলেন, এই ফ্লাইওভারের নিচের এমন কোনো অংশ নেই যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নেই। এসবের কারণে ফ্লাইওভারসহ শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। যত্রতত্র পোস্টারের কারণে ঘিঞ্জি আর বিশ্রী লাগে। যে যার মতো করে পোস্টার মেরে গেছে। শহরের সৌন্দর্য রক্ষা করা সিটি কর্পোরেশনের কাজ। তাই তাদের প্রতি দাবি জানিয়ে বলতে চাই যত্রতত্র লাগানো এসব বিজ্ঞাপনী পোস্টার সরিয়ে পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নেন। চলাচলের সময় যত্রতত্র পোস্টার দেখতে কারোরই ভালো লাগে না। ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চালক বাবুল মিয়া বলেন, মৌচাক ফ্লাইওভারের কিছু অংশে বিভিন্ন পোস্টার ও বিজ্ঞাপন আছে যা আমাদের মতো চালকদের জন্য খুবই সমস্যার। এর কারণ হলো, যাত্রীভর্তি বাস নিয়ে যখন ফ্লাইওভারের ওপর উঠি তখন বেশিরভাগ চালকদের চোখ ওইসব রঙিন ব্যানার ও পোস্টারের দিকে চলে যায়। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এমনিতেই ফ্লাইওভারের ওপরে খুব সাবধানতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হয়, এর মধ্যে যদি বিজ্ঞাপনে চোখ যায় তাহলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই ফ্লাইওভারের কোনো ধরনের পোস্টার থাকা উচিত নয়। ফ্লাইওভারের বেইলি রোডের সামনের অংশের নিচের দিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পোস্টারে ছেয়ে আছে। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে ফ্লাইওভারে কেন বিজ্ঞাপন সাঁটিয়েছেন তা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে বেশিরভাগই জানান বিষয়টি তাদের জানা নেই। ডিজিটাল অ্যাকাডেমি নামের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পোস্টারে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। তখন সেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হাবিবুর রহমান বলেন, আসলে আমরা লোক দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞাপনী পোস্টার লাগিয়েছি। তারা কোথায় কোথায় এসব পোস্টার লাগিয়েছে তা আমাদের জানা নেই। যদি ভুলে ফ্লাইওভারে লাগিয়ে থাকে তাহলে আমরা সেগুলো সরিয়ে ফেলব। এ বিষয়ে শান্তিনগর এলাকায় দায়িত্ব পালন করা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্নতা সুপারভাইজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মাঝে মাঝে ফ্লাইওভারগুলোতে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে ওগুলো তুলে ফেলে। আমাদের নির্দেশনা আছে এগুলোতে যেন যত্রতত্র পোস্টার কেউ না লাগাতে পারে বা অপরিচ্ছন্ন না থাকে। আমরা এগুলো পরিচ্ছন্ন রাখতে দ্রুত কাজ করব। এদিকে, ডিএসসিসির আওতাধীন ফ্লাইওভারগুলোতে যেন কোনো ব্যক্তি ও সংস্থা পোস্টার বা বিজ্ঞাপন লাগাতে না পারে সে বিষয়ে মনিটরিং করার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। বিষয়টি মনিটরিংয়ে লোকও নিয়োগ দিয়েছে ডিএসসিসি। এ বিষয়ে এরইমধ্যে একটি অফিস আদেশও জারি করেছেন সংস্থাটির সচিব আকরামুজ্জামান। তিনি জানান, কোনো ফ্লাইওভারে কেউ বিজ্ঞাপন ও পোস্টার যেন না লাগাতে পারে তা মনিটরিং করতে এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বিষয়টি মনিটরিং করবেন। অন্যদিকে, ফ্লাইওভারের মগবাজার অংশে কিছু পিলারে নান্দনিক চিত্রকর্ম করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। রঙ আর তুলিতে রঙিন পালকের ময়ূর, ফুল, লতাপতা, পাখি ও রিকশাকে ফুটিয়ে তুলে রাঙানো হয়েছে মগবাজার অংশের পিলারগুলো। তবে এসব পিলারে বিজ্ঞাপন চোখে না পড়লেও অন্য পিলারগুলোতে পোস্টার ও বিজ্ঞাপন সাঁটাতে ছাড় দেয়নি বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ডিএনসিসির কারওয়ান বাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ফ্লাইওভারের পিলারসহ উপরের অংশে ব্যানার, পোস্টার ও বিজ্ঞাপনগুলো সরিয়ে ফেলতে নিয়মিত কাজ করি। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে আমাদের কড়া বার্তা দেওয়া আছে যে, মগবাজার অংশের ফ্লাইওভার যেসব পিলারে আমাদের চিত্রকর্ম করা আছে, সেগুলোতে কেউ কখনো যেন পোস্টার ও ব্যানার টানাতে না পারে। আমাদের কড়া মনিটরিংয়েরে কারণে সেখানে কেউ পোস্টার ও ব্যানার লাগায়নি। তবে অন্যান্য অংশে এসব লাগানো থাকলে আমরা দ্রুত সরিয়ে ফেলব। এদিকে, ব্যানার, পোস্টার ও বিজ্ঞাপনে যেন শহরের সৌন্দর্য নষ্ট না হয় সেই লক্ষ্যে চলতি বছরের শুরুতে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে ডিএনসিসি। এরই ধারাবাহিকতায় ডিএনসিসির আওতাধীন কয়েকটি স্থানে পরীক্ষামূলক পাইলটিং প্রকল্প হিসেবে ব্যানার, পোস্টার ও বিজ্ঞাপন লাগোনোর জন্য ১৬/৬ ফুট সাইজের বড় বোর্ড বসানো হয়। পাশাপাশি নির্ধারিত স্থানে সবাইকে পোস্টার, ব্যানার ও বিজ্ঞাপন টানাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেসময় ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই প্রকল্পে বোর্ডগুলোতে সাধারণ মানুষ কীভাবে তাদের প্রচারণায় পোস্টার লাগাবে, একজন কয়টি পোস্টার লাগাতে পারবে অথবা লাগানো পোস্টার কতদিন রাখা যাবে, সব বিষয় নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সুফল বয়ে আনতে পারেনি ডিএনসিসির প্রকল্পটি। নির্ধারিত স্থানে বিজ্ঞাপনের জন্য এসব বড় বড় বোর্ড বসানো থাকলেও, সেখানে তেমন কোনো পোস্টার ও বিজ্ঞাপন দেখা যায় না।