কুলিদের হাঁকডাক আর লঞ্চ যাত্রীদের ঠেলাঠেলিতে মুখর ছিল সদরঘাটের চারপাশ। যা এখন শুধুই স্মৃতি। ফলে পুরান ঢাকার সদরঘাট এখন আর আগের মতো নেই। সড়কে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় জৌলুস হারাতে বসেছে লঞ্চঘাট। ২০২২ সালের ২৫ জুন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়।
রাতারাতি বদলে যায় সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলে নির্ধারিত নৌপথ অর্থাৎ ৪১টি রুটের চলাচলের দৃশ্যপট। লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদরুজ্জামান বাদল বলেন, আমরা হাওয়া খেয়ে বেঁচে আছি। কোনো কিছুতেই যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। আমার নিজের সব লঞ্চ বিক্রি করে দিয়েছি। ঠিকাদারকে দিয়ে দিছি, তারা কেজি হিসেবে লোহা বিক্রি করবে। লঞ্চ ব্যবসায় একদম ধস নেমেছে।
এভাবে কতদিন চলবে জানি না। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে দক্ষিণের মানুষের যাতায়াত সহজ তো হয়েছেই, সময় বাঁচার পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। কিন্তু কপালে ভাঁজ পড়েছে লঞ্চ মালিক আর শ্রমিকদের। নিয়ম করে আর ঘাটে লঞ্চের সাইরেন বাজে না। যাত্রী চলাচল অর্ধেকে নেমে এসেছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের বিলাসবহুল ১২টি লঞ্চ। যেক’টি আছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নেই। সুন্দরবন লঞ্চের কেবিন বয় ফিরোজ জানান, পদ্মা সেতু দিয়ে বাসে গেলে সময় লাগে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। ফলে মানুষ এখন বাসেই বেশি যাতায়াত করছে। যাদের সঙ্গে মালামাল বেশি থাকে তারা বাসে না গিয়ে লঞ্চে যাচ্ছে, অসুস্থ ব্যক্তিরাও কেবিনে যাচ্ছে। রোটেশনে প্রতিদিন দুটি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। এরপর তিন দিন ঘাটে অবস্থান করে চতুর্থ দিনে আবার চলাচল করে।
এভাবে করেও লাভ হচ্ছে না লঞ্চ মালিকদের। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, রোটেশন করে আমাদের অনেক লঞ্চ বন্ধ করে শুধু একটা থেকে দুটা ঘাটে রাখা হয়। সেগুলাতেও যাত্রী হয় না। কোনো উৎসবে বিশেষ করে ছুটির সময় হলে যাত্রী একটু বাড়ে। লঞ্চ মালিকদের সূত্রে জানা যায়, গত কোরবানির ঈদের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌরুটে যাত্রী না হওয়ায় তিনটির জায়গায় দুটি একটি করে এরপর ১০টি নৌ-রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। ঢাকা-বরগুনা, ঢাকা-মাদারীপুর, ঢাকা-তুষখালী, ঢাকা-পয়সারহাট, ঢাকা-আমতলী, ঢাকা-পাতারহাট, ঢাকা-টরকী, ঢাকা-রাঙ্গাবালী, ঢাকা-ঘোষেরহাট ও ঢাকা-পাতাবুনিয়া রুটে এখন লঞ্চ চলাচল বন্ধ। নদীবন্দরের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহণ সংস্থার পরিচালক মামুন অর রশিদ বলেন, একটি লঞ্চের ৯০ শতাংশ খরচই হয় তেল বাবদ। এরপর শ্রমিক-কর্মচারী, লঞ্চ মেরামতেও অনেক খরচ। একটি বড় লঞ্চ চলতে প্রতি ট্রিপে ৫-৭ লাখ টাকার শুধু তেল-ই লাগে। লঞ্চের আকার ভেদে একটি লঞ্চ চালাতে ২০ থেকে ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রয়োজন হয়। মাঝে মাঝে এই তেলের টাকাও আমাদের ওঠে না। যাত্রীশূন্য হয়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। নৌ-নিরাপত্তা ট্রাফিক বিভাগের পরিবহন পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, আমরা সবসময় ঘাটেই থাকি। যারা পরিবারসহ যাতায়াত করেন তারা এখনও লঞ্চে যাচ্ছেন। কিন্তু সিঙ্গেল যাত্রী যারা তারা একদম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। চাকরিজীবীরা ৫টায় অফিস শেষ করে গুলিস্তানের যানজট পেরিয়ে ৯টায় লঞ্চের জন্য বসে থাকে না। তারা সাড়ে ৯টার মধ্যেই বরিশাল পৌঁছে যায়। বিআইডব্লিউটিএ’র (বন্দর) যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, পদ্মা সেতু হলে যাত্রী কমবে এটা স্বাভাবিক। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। এভাবেই থাকবে। যখন পদ্মা সেতু হয়, তখন লঞ্চ মালিকদের ভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া দরকার ছিল।