ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিটি এখন শুধু নামেই টিকে আছে। ১৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিটি কালের বিবর্তনে এখন ধুঁকছে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্যের জৌলুস হারিয়ে এখন এটি নামমাত্র লাইব্রেরি। স্বাধীনতা-পরবর্তী জেলায় জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার হওয়াতে কমে গেছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির কদর। এখন বই, লাইব্রেরিয়ান, জনবল ও বরাদ্দ সংকটে তেলহীন বাতির মতো জ্বলছে এই জ্ঞান গৃহ। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে এখন বই পড়ার তেমন সুযোগ নেই। নেই আগের মতো পত্রিকাতে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার সুযোগ। জনবল সংকটের অজুহাতে বস্তায় ও তালাবন্দি হয়ে পড়ে আছে হাজারো বই।
বই থেকেও যেন বই পড়তে মানা। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু বই রয়েছে উন্মুক্ত। খবরের কাগজ পড়ে অভ্যস্ত পাঠকরাও এখন হতাশ। সেখানে নেই আগের মতো পত্রিকা। সাতটি পত্রিকার তালিকা থাকলেও অর্থ সংকটে এখন পাঠকের খোরাক মাত্র পাঁচটি। জীর্ণ দশার এই লাইব্রেরিতে প্রতিদিনের নতুন সংযোজন বলতে শুধু পত্রিকাই।
লাইব্রেরির চারটি কক্ষের একটা কোল ঘেঁষা জেলা শিল্পকলা একাডেমির পেটে চলে গেছে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি পরিত্যক্ত। লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষে পাঠকের বসার জন্য রয়েছে কয়েকটি প্লাস্টিক চেয়ার। আছে বহু পুরাতন একটি টেবিল। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির সেবা তো দূরের কথা লাইব্রেরির সেবার জন্য কেউ নেই। একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আর এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীই এখানকার সব। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক এর অভিভাবক হলেও তার মাথা ব্যথা নেই।
এ কারণে লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকা রোগীর মতো ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রাচীনতম লাইব্রেরিটি। সম্প্রতি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পাঠক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইব্রেরিটি খোলা থাকে। রংপুর ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রিকা থেকে এখানে বাছাই করা পাঁচটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। এখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক বই, পাণ্ডুলিপি, পুথি, উৎকীর্ণলিপি ও প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ।
এখনকার কেয়ারটেকার আজিজুল ইসলাম ছানু। পনেরো বছর ধরে এখানে চাকরি করছেন। বেতনভাতা হিসেবে তার প্রতিদিনের হাজিরা ১০০ টাকার নিচে।
মাস শেষে জোটে মাত্র ২৫০০ টাকা। ছানু বলেন, লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এর কোনো দাতা নেই। বছর দুয়েক আগে লাইব্রেরির সংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো জনবল নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। একজন লাইব্রেরিয়ান ছিল, বেতন ঠিক মতো না পাওয়া তিনিও চাকরি ছেড়েছেন। এখন তেমন পড়ার মতো বইও নেই। কামরুল হাসান নামে আরেক পাঠক বলেন, এক সময় এখানে অনেক বই ও পত্রিকার পাঠক ছিল। কিন্তু এখন পাঠক কমে গেছে। জনবল নেই। পড়ার উপযোগী কোনো বই নেই।
কিছু পুরাতন বই আছে, তাও উইপোকা, তেলাপোকা কাটা, ধুলাবালু, বৃষ্টির পানি পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবেই নামে মাত্র টিকে আছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। স্থানীয় সংগঠকরা জানান, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সরগরম ছিল এই লাইব্রেরি। বহু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সংগঠক মনা মানুষের ওঠা-বসা ছিল এখানে। বই-পত্রিকার সমারোহে ছিল হাজার হাজার পাঠকও। দীর্ঘদিনের পুরোনো বই এভাবেই অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই লাইব্রেরির এক সময়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সভাপতি কাজী জুননুন বলেন, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে নতুন প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এর সঙ্গে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এটাকে এভাবে অবহেলিত রাখতে দেওয়া ঠিক হবে না। আধুনিক পাঠাগার করে রংপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে লাইব্রেরিমুখি করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।