রংপুরে ঔষধি ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ বিদেশি জাতের ‘ব্ল্যাক রাইস’ বা কালো ধান চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মিলন রায়। ২০ শতাংশ জমিতে তিনি এ ধান চাষ করেছেন। ফলনও বাম্পার হয়েছে। বিদেশি জাতের এ ধান উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় এলাকার অন্য চাষিরাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তারাও বীজ সংগ্রহ করে ভবিষ্যতে এ জাতের ধান চাষ করবে বলে জানিয়েছেন। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘ব্ল্যাক রাইস’ ঔষধি ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এই ধানে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে থাকা ফাইবার হার্টকে সুস্থ রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া এ ধানের চালে রয়েছে ডায়াবেটিস, স্নায়ুরোগ ও বার্ধক্য প্রতিরোধ ক্ষমতা।
রংপুর মহানগরীর ৬নং ওয়ার্ডের চব্বিশ হাজারী উত্তরপাড়া গ্রামে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মিলন রায় ইউটিউবে প্রথম এ ধানের চাষাবাদ সম্পর্কে জানেন। পরে ৫০০ টাকা দিয়ে পঞ্চগড় থেকে সাবেক একজন সেনা সদস্যের কাছ থেকে ২ কেজি বীজ কিনেছিলেন। ২০ শতক জমিতে ব্ল্যাক রাইসের পাশাপাশি ২৫ শতক জমিতে বি-৫২ প্রজাতির ধান চাষ করছেন। জানা গেছে, ব্ল্যাক রাইস ধানের উৎপত্তি ইন্দোনেশিয়ায়। অধিক ঔষধি গুণ থাকায় এক সময় চীনের রাজা-বাদশাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য গোপনে এই ধান চাষ করা হতো। যা প্রজাদের জন্য চাষ করা বা খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এ কারণে এই ধানকে নিষিদ্ধ ধানও বলা হতো। পরবর্তীতে জাপান ও মিয়ানমারে এই ধান চাষ শুরু হয়। সেখান থেকে আসে বাংলাদেশে।
পার্বত্য এলাকায় এ চালকে বলা হয় পোড়া বিন্নি চাল। থাইল্যান্ডে একে বলে কাও নাইও ডাহম। চীনের সপ্তদশ শতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মূল্যবান ব্ল্যাক রাইস বা কালো ধান এখন রংপুর নগরীতে চাষ করছেন মিলন রায়। তার ব্ল্যাক রাইস নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলের কমতি নেই। স্থানীয় কৃষক আইয়ুব আলী বলেন, বিদেশি জাতের ধান আমাদের এই এলাকায় প্রথম চাষ হচ্ছে। অল্প টাকা ও পরিশ্রমে ধান ভালোই হয়েছে। মিলনের দেখে এলাকার অনেকেই এই ধান চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি নিজেও পরীক্ষামূলকভাবে এই ধান লাগাব। একই এলাকার কৃষক নূরু মিয়া বলেন, কালো ধান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসছে। আমি নিজেও ধানখেত দেখে এসেছি। ফলন তো ভালো হয়েছে। এ ধানে সার ও কীটনাশক কম লাগে। বীজ সংগ্রহ করতে পারলে আগামীতে আমিও কালো ধান আবাদ করব। আশা করছি অন্যরাও বিদেশি এই ধান চাষাবাদে এগিয়ে আসবে।
মিলন রায়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ব্ল্যাক রাইসকে স্বাভাবিক ধানের মতোই পরিচর্যা করতে হয়। অতিরিক্ত কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন না হলেও অন্য ধানের তুলনায় অধিক লাভবান হওয়া যাবে। এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছেন তিনি। তবে তিনি বাণিজ্যিকভাবে এটি বিক্রির বিষয়ে অনেকটাই চিন্তিত। উৎপাদিত এই কালো রঙের চাল কোথায় বিক্রি করবেন তা এখনো অজানা। কৃষি কর্মকর্তার কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে মিলন রায় জানান, তিনি এ বিষয়ে কোনো দপ্তরেই যোগাযোগ করেননি। তবে ধান কাটা মাড়াইয়ের পর যোগাযোগ করবেন। এদিকে ব্লাক রাইস চাষাবাদে সফলতার গল্প জানতে কথা বলা হয় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পিরব এলাকার ফকির সোহেলের সঙ্গে। তিনি ২০১৯ সাল থেকে ব্ল্যাক রাইস বা কালো ধান চাষ করে আসছেন। অল্প মুনাফা বিনিয়োগ করে কালো ধানে অধিক লাভবান হওয়ায় সবার মাঝে সাড়া ফেলেন সোহেল। কালো ধানের বীজ নিজ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন তিনি। ব্ল্যাক রাইস ধান চাষি ফকির সোহেল জানান, এই ধান চাষে কম খরচে কয়েকগুণ লাভ হয়।
সাধারণ জাতের ধান প্রতি বিঘাতে যেখানে ১৮ থেকে ২০ মণ উৎপাদন হয় সেখানে কালো ধান প্রতি বিঘাতে ২৮ থেকে ৩০ মণ পাওয়া যায়। বাজারে এই ধানের চালের বেশ চাহিদা থাকায় দামও অনেক। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, ব্ল্যাক রাইস রোপণ ও চাষাবাদ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেননি তিনি (মিলন রায়)। বিদেশি জাতের এই ধান কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত। তারা কয়েকটি অ্যাপসের মাধ্যমে এ ধরনের ব্যতিক্রমী কিছু চাল বিক্রি করে থাকেন। এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে বিক্রি করা অনেকটাই কঠিন। তবে কিছু কিছু সুপারশপে এটি বিক্রি করা সম্ভব। আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে। তিনি আরো বলেন, ব্ল্যাক রাইস পুষ্টিসমৃদ্ধ, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই ধান চাষে আমাদের অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন। আমরাও উদ্বুদ্ধ করছি। উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।