১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোয় অসংখ্য মানুষকে রংপুর টাউন হল চত্বরে এনে হত্যা করা হয়েছিল। সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি ধারণ করে এখনো দাঁড়িয়ে থাকা রংপুর টাউন হল যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। টাউন হলে একসময় মুখরিত হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিকের পদচারণা। এখান থেকেই অনেক ক্ষণজন্মা পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাঙালি সংস্কৃতির মুক্ত চিন্তার পথ দেখিয়েছেন। বহু সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কারের সাক্ষী হয়ে অনেক আনন্দ বেদনার কাব্য ধারণ করে রংপুর নগরীর ঠিক মধ্যখানে কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হল। রংপুরে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ক্যাম্প-টাউন হলে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। টাউন হলের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল ‘রংপুর নাট্য সমাজ গৃহ’। রংপুরের অনেক স্থাপনার সাথে মিশে রয়েছে কাকিনার রাজা মহিমা রঞ্জন রায়ের নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে অনগ্রসর বাঙালিকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্যে ১৮৯১ সালে রংপুরের উৎসাহিত নাট্য সমাজকে একটি রঙ্গশালা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি (রাজা) ১০ বিঘা ৩ কাঠা জমি দান করেন। নির্মিত হয় রংপুর টাউন হল। এখনো রংপুর টাউন হল তারই মহিমার গৌরব গাথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শুরুর লগ্নে টাউন হলের অবস্থান হতে ধীরে ধীরে উন্নয়ন হয়ে বর্তমানে টাউন হল চত্বরে অবস্থান নিয়েছে বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার, রংপুর সাহিত্য কেন্দ্র, লেখক পরিষদ, অভিযাত্রী, সাহিত্য মঞ্চ, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, শিখা সংসদ, টাউন হল, শিল্পকলা একডেমী, রংপুর ফাউন্ডেশন, পাবলিক লাইব্রেরি হলরুম, রংপুর সাহিত্য পরিষদ, আঞ্চলিক লোক সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, যেগুলোন টাউন হলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ভূমিকা রাখছে এবং জমজমাট করে রাখছে।
রংপুর টাউন হল চত্বরে বর্তমানে রাজনৈতিক, সামাজিক, সংগঠনসহ বিভিন্ন সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি টাউন হলে বা চত্বরে পালন করে থাকেন। যা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার নিদর্শন। রংপুরের নাট্যকর্মী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এসএম আরিফুজ্জামান বলেন, রংপুর টাউন হলের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এটি ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং তারপর বাংলাদেশ- এই পুরো সময়টাতেই টাউন হলের একটি ঐতিহ্য ছিলো এবং রয়েছে। এখানে যেসব সাংস্কৃতিক পল্লী তৈরি হয়েছে সেই সংস্কৃতি পল্লিগুলোর সঙ্গে অনেক নাট্য সংগঠনও জড়িয়ে আছে। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি, যদিও এটি পুরোনো একটি স্মৃতি। সেই স্মৃতিটাকে ভেঙে না ফেলে বা নষ্ট না করে এটির যদি উন্নয়ন করা যায় এবং ধরে রাখা যায় তাহলে আমরা গর্বের সাথে এই টাউন হলটিকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারব গোটা বিশ্বের কাছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ইতিহাসের একটা রাজ সাক্ষী রংপুর টাউন হল। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর টর্চার সেল ছিল এটি। স্টেজের পিছনে এবং টাউন হলের পেছনে অসংখ্য নর-নারীর লাশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে হানাদাররা রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নারী-পুরুষদের ধরে এনে নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করে মরদেহ ফেলে রাখত এই ক্যাম্পে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুরে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ক্যাম্প-টাউন হলে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানেই গড়ে উঠেছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি স্মারক।
টাউন হলের ইলেক্ট্রিশিয়ান আহসান হাবীব বকুল বলেন, আমি প্রায় ৪৪ বছর হতে এখানে কর্ম করে খাচ্ছি। আমি যখন এখানে জয়েন করি, তখন হাফওয়ালের টাউন হল ছিল। ধীরে ধীরে এখন টাউন হল চত্বরে গণগ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে। এগুলোন বেশি দিনের কথা নয়। শিল্পকলা একাডেমীও অনেক পরে হয়েছে। আমার বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে যেতে চাই।