দেশে ২০০১ সালে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে নিপাহ ভাইরাসে, যা মোট আক্রান্তের ৭১ শতাংশ। নিপাহ প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এর মাঝেও চলতি ২০২৩ সালে গত ৭ বছরে সর্বোচ্চ ১৪ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে মোট ১০ জন মারা গেছেন। গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) অডিটোরিয়াম ‘নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার এবং ঝুঁকিবিষয়ক অবহিতকরণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
সভায় আলোচকরা বলেন, ২০০১ সালে প্রথম দেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। ভাইরাসজনিত রোগটি সারাদেশের মোট ৩৪টি জেলায় ছড়িয়েছে। রোগটিতে এখন পর্যন্ত মোট ৩৩৯ জন আক্রান্ত এবং মারা গেছেন ২৪০ জন। অর্থাৎ, আক্রান্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার শতকরা ৭১ শতাংশ। মৃত্যুহার বিবেচনা যা অত্যন্ত শঙ্কাজনক। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ১৪ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। ২০২৩ সালের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়, চলতি বছর সারাদেশের মোট সাতটি জেলায় ১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো নরসিংদী জেলায় সংক্রমণ ঘটেছে।
এটি নতুন করে শঙ্কার কারণ। এতদিন শুধু উত্তরাঞ্চলে ঘটছে ধারণা করা হলেও এখন তা মধ্যাঞ্চলে পাওয়া গেছে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নিপসমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা যে কয়টা সার্ভিলেন্স কাজ পরিচালনা করি তার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে নিপাহ সার্ভিলেন্স। কিন্তু এত কিছুর পরও নিপাহ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমরা জ্বর ও খেজুরের রস খাওয়ার ইতিহাসে আটকে আছি। মালয়েশিয়া ও ভারতের কারণের সাথে আমাদের মিল নেই। লক্ষ্যণীয় বিষয়, খেজুরের রস নেই- এমন দেশেও নিপাহ সংক্রমণ ঘটছে। অর্থাৎ, অন্য সোর্স থেকেও ঘটছে। তবে আমাদের দেশে এখনো তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু হতে পারে না, তেমন নয়। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাই দ্রুত শনাক্ত হলেই বেঁচে যাবেন, তা বলা কঠিন। আর যারা বেঁচে যান তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না।
তারা পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। অর্থাৎ, প্রতিরোধ ছাড়া নিপাহ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। আমরা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হই। নিজে না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও যখন রস উৎসব বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে থাকি তখন ঠিকই খাচ্ছি। এটি বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। হাসপাতালে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিপাহ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করতে চায় না। কেন না, সেবাদানকারী ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হতে পারেন। এ অবস্থায় হাসপাতাল শাখাকে বলব- সব হাসপাতালে চিঠির মাধ্যমে একটি ওয়ার্ড ডেডিকেটেড করা। যেন রোগীকে আইসোলেটেড করা যায়। আমরা করোনার সময় পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছি। আমরা তা অনুসরণ করতে পারি। ওয়ান হেলথের ড. নিতিশ দেবনাথ বলেন, অনেক দিন ধরে মানুষকে সচেতনে কাজ করা হচ্ছে, কিন্তু সচেতনতা তৈরি হয়নি। নিপাহ ভাইরাস অত্যন্ত কমপ্লেক্স একটি রোগ। আমরা জানি, নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষে ছড়ায়। কিন্তু এটা কমপ্লেক্স প্রক্রিয়াতেও ঘটতে পারে। যেমনটা আমরা প্রথম সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখেছি। বাদুড়ে খাওয়া ফল শুকর, আর শুকর থেকে নিপাহ মানুষে ছড়িয়েছে। এটি আমাদের দেশেও ঘটতে পারে। তাই মানুষের সচেতন হতে হবে। আমাদের সাইন সিমটম দেখা দেওয়ার পরপরই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যেহেতু এর কোনো প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন নেই, তাই এটি প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবুল হোসেন মঈনুল হোসেন বলেন, আমরা যতদিন আইনি বিধির মধ্যে না আনব তা কতটা কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। খাবেন না বললেই মানুষ খেজুরের রস খাবে না তা নয়। এই বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় কি না, তা আইইডিসিআর বিবেচনা করতে পারে। এমআইএসের পরিচালক অধ্যাপক শাহদাত হোসেন বলেন, আমরা যে তথ্যটা দিয়েছি তা কনফার্ম কেইস। আমরা নিশ্চিত না সমসাময়িক সময়ে যারা মারা গেছেন তারা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল কি না। আমাদের কেইস শনাক্তে আরো জোর দিতে হবে। যেহেতু এই রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই মানুষের কাছে এর তথ্যগুলো পৌঁছে দিতে হবে। এর লক্ষ্যে আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।