রিকশার নগরী ঢাকায় নেই রিকশা আর্ট

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকাকে বলা হয় রিকশার নগরী। ঢাকা তো বটেই, দেশের অন্যান্য শহর-নগর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জেও তিন চাকার রিকশা যাতায়াতের অন্যতম বাহন। রিকশা শুধু ঐতিহ্য নয়, আরামদায়ক এবং কারুকার্যময় একটি বাহন। রিকশার আরোহীরা যেমন রিকশায় চলাচল উপভোগ করেন, তেমনি রিকশার পেছনে সাঁটানো টিনের শিটে (ঝুলবোর্ড) নানা চিত্রকর্ম মুগ্ধ করত পথচারীদের। একই সঙ্গে নানা ধরনের বাণী ও হাস্যরসাত্মক উক্তি ছড়িয়ে দিত মানুষের মধ্যে। বিচিত্র জীবজন্তু, ফুল, পাখি, লতাপাতা কিংবা চলচ্চিত্র তারকাদের চিত্র দিয়ে চাকচিক্য করে তোলা হতো রিকশাকে। ঠাঁই পেতো মনীষী বা বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিরন্তন বাণী ও বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক উক্তি। তবে টিনের পাতে ফুটে ওঠা দেশীয় এই সংস্কৃতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। শহরের বুকে এখনো রিকশা দাপিয়ে বেড়ালেও রিকশার পেছনে টিনের শিট এখন প্রায় ম্রিয়মাণ। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবে রিকশাচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিতে নানান ধরনের পেইন্টিং ও চিত্রকর্ম অল্প সময়ে ও কম খরচ হওয়ায় রিকশাওয়ালারা সেদিকেই ঝুঁকছেন। রিকশাচিত্রের শিল্পীরাও রং-তুলি থেকে দূরে সরে গেছেন। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য।

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে রিকশাচিত্রকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন।

সম্প্রতি ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র ইউনেস্কোর ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আফ্রিকার বোতসোয়ানার কাসানে শহরে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ সংরক্ষণ-বিষয়ক কনভেনশনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিষদের সভায় এ বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে রিকশার চিত্রশিল্পীরা সম্মানিত বোধ করছেন। তবে রিকশাচিত্রের এসব স্বীকৃতি মিললেও রিকশার পেছনে নেই রিকশাচিত্রের ছাপ। চিত্রশিল্পীরা জানিয়েছেন, ৯০ দশকে রিকশাচিত্রের যে জনপ্রিয়তা ছিল, সেটি হারাতে বসেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশে এখন কেউ বেশি দাম দিয়ে রিকশাচিত্র বানাতে চান না। সবাই এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। রং ও পারিশ্রমিক বেশি হওয়ার কারণে কেউ পেইন্টিং করতে চান না। ডিজিটালে নামমাত্র মূল্যে পেইন্টিং পাওয়ায় রিকশাওয়ালারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে রিকশাচিত্র বানাতে চান না। পুরান ঢাকার হোসেনি দালান রোডের ছোট্ট একটি ঝুপড়ি দোকানে রিকশাচিত্র, সিনেমার পোস্টার, ও গৃহস্থালির নানান অনুষঙ্গের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ডেনমার্ক ফিল্ম ব্যানার ফেস্টিভ্যালে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত রিকশা চিত্রশিল্পী হানিপ পাপ্পু। ৫৫ বছর থেকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তিনি। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে।

চিত্রশিল্পী সোলায়মান বলেন, ‘এখন শহর-গ্রামে যে রিকশাগুলো ছুটে চলছে এগুলোর পেছনে তাকালেই বোঝা যাবে এই রিকশাচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। সব রিকশার পেছনে ডিজিটাল প্রযুক্তির পোস্টার সাঁটানো। প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এখন কষ্টসাধ্য। আমরা অন্যান্য কাজ করে মোটামুটি খেয়েপরে বেঁচে আছি।’ জানা যায়, ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট : রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। এছাড়া জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। ২০১৩ সালে জাপানের তাকামাতসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে।