দেশের সর্ববৃহৎ একমাত্র ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির হাট রাজধানীর ডেমরার শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীর ঘেঁষে বয়ে চলা ডেমরা বাজারে অবস্থিত জামদানির হাট। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো এই হাটটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন হাট। এ হাটেই নাকি বিক্রি হতো মসলিন কাপড়। এখনো এ হাটটির ওপর নির্ভর করে চলছে শীতলক্ষ্যা ও বালু তীরের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও উপজেলার জামদানি শিল্প।
সোনারগাঁয়ের আফজাল জামদানি হাউজের মালিক আফজাল হোসেন বলেন, ২০ বছর ধরে এই কাজ করছি। আমরা যারা এই শাড়ি তৈরি করি কেউই সঠিক মজুরি পাই না। তবে আমাদের কাছ থেকে কিনে যারা বিক্রি করছেন, তারা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। ৫০০ টাকার একটি শাড়ি তৈরি করতে আমাদের এক সপ্তাহ লেগে যায়। এই দামের শাড়ি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ চারটা তৈরি করা সম্ভব হয়। আর ২০ হাজার টাকার শাড়ি তৈরি করতে গেলে ৩ সপ্তাহ চলে যায়। বর্তমানে সঠিক মজুরি না পাওয়ায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। জীবিকার তাগিদে ছোটবেলা থেকে আমি এই কাজ করে আসছি। বর্তমানে যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তারা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছেন। তাদের অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এই শিল্পের খারাপ সময় যাওয়া সত্ত্বেও অনেকেই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পেশা ছাড়তে পাচ্ছে না। প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জামদানি হাউজে গিয়ে জানা যায় তাঁতিদের এমন দুর্দশার কথা। জামদানি শাড়ি একসময় গর্বের বস্তু ছিল। এই শাড়ি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। তাঁতিদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় শাড়িতে ফুটে উঠে বাংলার প্রাকৃতি, ফুল, লতা-পাতা, বিভিন্ন প্রাণীর দৃশ্যসহ বাহারি সব নকশা। জামদানি শাড়ির প্রতি নারীদের অন্যরকম ভালোবাসা আছে। বাংলার এক অনবদ্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন এই জামদানি শিল্প। ইউনেস্কো ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে এই শিল্পের কারিগররা ভালো নেই। একদিকে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া অন্যদিকে নতুন করে এই পেশায় জড়িত না হওয়ায় কমছে জামদানি হাউজের সংখ্যা। ফলে সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প হারাতে বসেছে। বাবুল প্রধান জামদানি হাউজের কারিগর ইব্রাহীম বলেন, ২৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। মামা, খালাদের দেখে এই পেশায় এসেছি। বর্তমানে এখানে ১৪ জন কারিগর আছেন। যারা সবাই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। আগে তাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো তা দিয়ে সংসার চললেও এখন তা দিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ কারিগররা আগের প্রজন্ম থেকে এই কাজ শিখলেও এখনকার প্রজন্মের কেউই এই কাজ শিখতে আগ্রহী নয়। সোনারগাঁয়ের স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেন শুভ বলেন, ৩-৪ বছর আগেও জামদানি শিল্পের অবস্থা তুলনামূলক ভালো ছিল। তখন জামদানি শাড়ির চাহিদা ও দাম দুটোই ভালো ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের সময় জামদানি শিল্পের খারাপ অবস্থা হয়। ওই সময় তারা কোনো শাড়ি বিক্রি করতে না পারায় বেশিরভাগ কারিগররা এ পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে। আবার সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ির দাম বেড়েছে। এর ফলে শাড়ির চাহিদা অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও বাড়েনি কারিগরদের মজুরি। এছাড়া এই কাজটা করতে অনেক ধৈর্য্য ও দক্ষ হতে হয়। যা সবার পক্ষে সম্ভব না। অন্যসব পেশায় সর্বোচ্চ ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়; কিন্তু এ পেশায় কারিগরদের ১৪-১৫ ঘণ্টা একটানা কাজ করে যেতে হয়। তিনি আরো বলেন, আগে আমাদের এলাকার ঘরে ঘরে এই জামদানি শাড়ির কাজ চলত। তখন পরিবারের সবাই একসঙ্গে আনন্দের সঙ্গে এই কাজটি করত। কিন্তু এটি হারাতে বসেছে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে ধরে রাখতে হলে সরকারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।