পুরান ঢাকার উৎসবমুখর আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব। পৌষ-সংক্রান্তি উৎসবটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতি বছর পৌষের শেষ দিনে উৎসবটি পালন করে থাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। পৌষের শেষ দিনে (সাকরাইন) ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় মাতেন তারা। এছাড়া স্থানীয়রা পালন করে থাকে ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি। সংস্কৃতি শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশ থেকে সাইকরাইন রুপ নিয়েছে। পৌষ ও মাঘ মাসের সন্ধিক্ষণে, পৌষ মাসের শেষদিন সারা ভারতবর্ষে সংক্রান্তি হিসেবে উদযাপিত হয়। তবে পুরান ঢাকায় পৌষ-সংক্রান্তি বা সাকরাইন সার্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রঙবেরঙের ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহরের আকাশ। এই সাকরাইনকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, লক্ষ্মীবাজার, নয়াবাজার, তাঁতীবাজার, গেণ্ডারিয়া, ধুপখোলা ও সূত্রাপুর এলাকায় ঘুড়ি, নাটাই ও মাঞ্জা দেওয়া সুতা বেচাকেনার ধুম পড়েছে। শাঁখারিবাজারে খুচরা দামে ঘুড়ি বিক্রি করছেন মোহন পাল। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবারের বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। সূত্রাপুরের মোঃ জাফর আহমদের ছেলে নাইম এসেছে ঘুড়ি কিনতে। নাইম বলেন, সব মিলিয়ে ৩০টা ঘুড়ি কিনেছি। পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা অনিক দশম শ্রেণির ছাত্র। গেণ্ডারিয়ার দিকে তাকে অনেকগুলো ঘুড়ি হাতে নিয়ে যেতে দেখা যায়। অনিক বলে, সাকরাইনের মূল আনন্দ হলো ঘুড়ি ওড়ানো। অপরের ঘুড়ি কেটে ফেলার মধ্যেই আসল মজা। তাই এবার ২৫টি ঘুড়ি ৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। বড়োরাও মেতেছে এ ঘুড়ি কেনার আমেজে। এ বিষয়ে আ. হান্নান বলেন, ঘুড়ি উড়ানোর মাধ্যেমে শৈশবের আনন্দ খুঁজে পাই। শৈশবের সোনালি ছবি দেখতে পাই। দিনব্যাপী ঘুড়ি উড়ানে শেষে দেখা যায় পুরান ঢাকার অলিগলিতে, বাসাবাড়ির ছাদে ডিজেপার্টি, নাইটপার্টির আয়োজন। উচ্চৈঃশব্দে গানের তালে তালে নাচে মাতে তরুণ-তরুণীরা। এটিকে সাকরাইনের অপসংস্কৃতি হিসেবে দেখেন অনেকে। এ বিষয়ে কগজিটোলার বাসিন্দা নিরব চৌধুরী বলেন, ঘুড়ি উড়ানোর এ সামাজিক উৎসবটি এখন অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। আমরা আগেও ঘুড়ি উৎসব (সাকরাইন) করাতাম। তখন ডিজেপাটি, নাইটপাটির আয়োজন ছিল না। সাকরাইন উপলক্ষ্যে নানা রকমের পিঠাপুলি ও বিভিন্ন স্বাদের খাবার আয়োজন করে স্থানীয়রা। সারা দেশে এই সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে থাকলেও সাকরাইন উপলক্ষ্যে কিছুটা ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। সাদিয়া আক্তার বলেন, এ দিনটিকে সবাই মিলে আনন্দ উল্লাস করি। ঘরোয়া আয়োজনে বিভিন্ন পিঠা-পুলির আয়োজন করি। পরিবারের মানুষদের খুশি করতে গিয়ে রান্নার কাজটি বাদ দিতে পারি না। সাকরাইন উপলক্ষ্যে গতকাল ঢাকা কলেজের ছাত্র আরিফুল হক ঘুড়ি কিনতে শাঁখারীবাজার এসেছেন। রং-বেরঙের ঘুড়ি কিনে ফিরছেন বাসায়। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব কবে শুরু হয়েছে তিনি নিজেই জানেন না। জন্মের পর থেকেই দেখছেন এ উৎসব। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে গেছে সাকরাইনের ঘুড়ির উৎসব। তিনি একসময় তার বাবার হাত ধরে ঘুড়ি কিনতে এসেছিলেন। আজকে নিজেই এসেছেন ভবিষ্যতে ছেলেকে নিয়ে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করে আরিফুল বলেন, আসলে এ উৎসব জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসব। এটা ঢাকার ঐতিহ্য যা শতকের পর শতক চলবে। ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি ও নাটাই কিনতে গেন্ডারিয়া থেকে শাঁখারীবাজার এসেছেন শুভ। তিনি বলেন, ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি-নাটাই কিনতে এসেছি। ১৫০টি ঘুড়ি ও ১০টি নাটাই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আগামীকাল সাকরাইন বাসার ছাদে ছোট খাটো অনুষ্ঠান হবে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় পরিজনরা মিলে ঘুড়ি উড়াব। এদিন আমাদের কাছে প্রাণের উৎসবে পরিণত হবে। সারাদিন ঘড়ি উড়িয়ে রাতে নানা রকমের পিঠা, পুলিসহ বিভিন্ন ধরনের খাওয়া দাওয়া হবে। নারিন্দার বাসিন্দা রহিম মিয়া ঢাকায় এসেছেন প্রায় ২৫ বছর।
তিনি বলেন, যখন গ্রামে ছিলাম তখন শখে ঘুড়ি উড়িয়েছি। এমন অনুষ্ঠান আয়োজন করে ঘুড়ি উড়ানো হয়নি। ঢাকাতে আসার পর এখন প্রতিবছর আয়োজন করে একদিন ঘুড়ি উড়িয়ে থাকি। সারাদিন আনন্দ-উল্লাস করি। তাই ঘুড়ি ও নাটাই কিনেছি। এখানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি ও নাটাই বিক্রি হয়, কিছু বাঁশের আবার কিছু আছে স্টিলের। ছোট নাটাই ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, মাঝারি ধরনের ২০০ থেকে ২৫০ এবং বড় নাটাই ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শাঁখারীবাজার মাতাশ্রী স্টোরে নাটাই-ঘুড়ি বিক্রি করছেন রঞ্জন ধর। তিনি বলেন, এ বছর ঘুড়ি ও নাটাই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম আগের তুলনায় একটু বাড়লেও ক্রেতার সংকট নেই। কয়েক দিন ধরে ক্রেতার ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। কাগজের দাম ও কারিগরদের পারিশ্রমিক বেড়ে যাওয়ায় ঘুড়ি-নাটাইয়ের দামও একটু বেড়েছে। এ বিষয়ে পুরান ঢাকার ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, সাকরাইন উৎসব পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। কালের পরিক্রমায় এ ঐতিহ্য পুরান ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যান্ত্রিক জীবনের বাস্তবতায় আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি, সাকরাইন উৎসব আমাদের ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদিন পুরান ঢাকার বাড়িগুলোর ছাদ যেন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়। যে কেউ ঘুড়ি নিয়ে এ উৎসবে অংশ নিতে পারবেন। এ উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত, সার্বজনীন।