পলিমালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করে সফল হয়েছেন উপকূলীয় খুলনার দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার কৃষকরা। লবণাক্ত এলাকায় হাইব্রিড মরিচের বাম্পার ফলন পেয়ে তাদের মুখে হাসির ফোয়ারা। ফসল উৎপাদনে আগাছার হাত থেকে রক্ষা পেতে পলিমালচিং পদ্ধতির ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন উপকূলীয় খুলনার দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার কৃষকরা। লবণাক্ত এলাকায় দিন দিন এ পলিমালচিং পদ্ধতি কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের প্রসার ঘটছে। পলিথিন ব্যবহারে জমিতে কোনো ধরনের আগাছা জন্মাতে পারে না এবং মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে রস জমা থাকে। এ কারণে ফসল ভালো হয়। কৃষকরা জানান, পলিমালচিং পদ্ধতিতে খরচ কম হয় এবং ফলনও ভালো হয়। জমিতে পলিমালচিং পদ্ধতিতে মরিচের পাশাপাশী তরমুজ, বেগুন, ক্যাপসিকাম, টমেটো, পেঁপে, শিম, করলা, শসা ও লাউসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করে ফলনও ভালো পেয়েছেন। জানা গেছে, পলিমালচিং পদ্ধতিতে শুরুতে একসঙ্গে কিছুটা খরচ বেশি হলেও পরে খরচ অনেক কমে যায়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে আগাছা হয় না বলে তা পরিষ্কারের কোনো ঝামেলা নেই। দফায় দফায় সার দেওয়ারও ঝামেলা নেই।
আর গাছ দীর্ঘজীবী হওয়ায় উৎপাদন হয় দীর্ঘসময় ধরে। ফলে অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করে আশানুরূপ লাভবান হন কৃষক। এ পদ্ধতিতে জমি তৈরির জন্য মাঝখানে দুই পাশ থেকে কেটে দেড় ফুট চওড়া করে ও ৮-১২ ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে বেড তৈরি করা হয়। তৈরি বেডগুলো মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্লাস্টিকের পলিমালচিং পেপারের কালো রঙের দিকটা থাকে নিচের দিকে আর রুপালি রঙের দিকটা থাকে ওপরের দিকে অর্থাৎ সূর্যের দিকে। এ পদ্ধতিতে সূর্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে মাটিকে রাখে ফসলের উপযোগী। পরে পলিমালচিং পেপারের দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল গোল করে কেটে নেওয়া হয়। এরপর কেটে নেওয়া জায়গায় রোপণ করা হয় বীজ বা চারা। এরপর তিন ফুট উঁচুতে বাঁশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুরের কৃষক প্রিতেশ বলেন, এসআরডিআই (অংঙ্গ) জিকেবিএসপি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাটি ও সার সহায়িকা পেয়ে পলিমালচিং পদ্ধতিতে কাঁচামরিচ চাষ করে আমাদের এই লবণাক্ত এলাকার মানুষ অনেক উপকৃত হয়েছে। এটা আসলে একটা বৈজ্ঞানিক আধুনিক পদ্ধতি। একবার কষ্ট করে চাষ করলেই হয়ে যায়, এতে করে দুই থেকে তিন বছর জমিতে আর ফসলের জন্য কাজ করতে হয় না।
ফলে উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনই ফলনও অনেক বেশি হচ্ছে। এ বছর ভালো দাম পাওয়ায় সব কৃষক লাভবান হয়েছেন। দিন দিন এ পদ্ধতিতে কাঁচামরিচ আবাদের পরিমাণ বাড়ছে। পাইকগাছা উপজেলার কৃষক মলয় মন্ডল বলেন, পলিমালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করে সফল হয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে মরিচ চাষ করে লাভবান হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় একবিঘা জমিতে মরিচ সুপার চাষ করেছেন কৃষক মলয়। মলয় মন্ডল (২৯) উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গড়ইখালী ইউনিয়নের হোগলারচক গ্রামের কালিপদ মন্ডলের ছেলে। স্নাতক পাস করে চাকরির পেছনে সময় অপচয় না করে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন মলয়। বাজারে মরিচের অধিক মূল্যের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন মরিচ চাষ করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালে ঘোষখালী নদীর ধারে ১২ কাঠা জমিতে মরিচের চাষ করেন। এতে তার ব্যয় হয় ৯৭ হাজার টাকা এবং বিক্রয় হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
অধিক লাভ দেখে মলয় সিদ্ধান্ত নেয় মরিচ চাষ বৃদ্ধি করার। সে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় পলি মালচিং পদ্ধতিতে ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর এক বিঘা জমিতে মরিচ সুপার হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা রোপন করে। এ চারা সে নিজেই ট্রেতে উৎপাদন করে। সাধারণ চাষের চেয়ে পলিমালচিং পদ্ধতি অধিক লাভ জনক। এ পদ্ধতিতে চাষ করলে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। অতিরিক্ত সেচ লাগে না, আগাছা জন্মাতে পারে না, লবণাক্ততা কম থাকে, রোগ বালাই ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ কম হয়, শ্রমিক খরচ কম লাগে, বেকারত্ব দূর হয়, ফলন বেশি হয় এবং একটি মালচিং ৩ বছর ব্যবহার করা যায়। এ সব সুবিধার কথা চিন্তা করে মলয় পলিমালচিং পদ্ধতিতে মরিচের চাষ করেছে। বর্তমানে তার খেতজুড়ে প্রতিটি গাছে প্রচুর পরিমাণ মরিচ ধরেছে। ইতোমধ্যে সে মরিচ ওঠানো এবং বিক্রয় করা শুরু করেছে। এ হাইব্রিড জাতের ফলন শুরু হওয়ার পর থেকে ৬ থেকে ৭ মাস ভালো ফলন দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরামর্শ প্রদানসহ সার্বিক সহযোগিতা করছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সোহাগ হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও আকরাম হোসেন। প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটলে বাম্পার উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষক মলয় মন্ডল।
১ বিঘা জমিতে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে এবং ৬ লাখ টাকার অধিক বিক্রয় হবে বলে আশা করছেন মলয় মন্ডল। কৃষক মলয়কে অনুসরণ করে এলাকার অনেকেই পলিমালচিং পদ্ধতির মরিচ চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ অসীম কুমার দাশ। কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের সবকিছুই এখন আধুনিক এবং স্মার্ট হচ্ছে। এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকরা মলয় মন্ডলের মতো স্মার্ট কৃষি চাষাবাদে এগিয়ে এলে দেশের বেকারত্ব অনেকাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। কৃষি চাষাবাদ কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী ব্যক্তিকে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা জানান। উল্লেখ্য, চলতি মৌসুমেই লবণ পানির চিংড়ি ঘেরে সরিষার আবাদ করে সফল হয়েছেন মালথ গ্রামের কৃষক সাহেব আলী ও মো: হারুন। লবণাক্ত এলাকায় এ ধরনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছে খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।