চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ত জহুর হকার্স মার্কেটে আগুনের ঘটনা ঘটেছে গত শুক্রবার। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছে মার্কেটটি। তবে এ ঘটনাই শেষ নয়। এর আগে ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় সমবায় মার্কেটে আগুন লেগে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি রেয়াজুদ্দিন বাজারের নূপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাজারের হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় এবং ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বারবার অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বেশিরভাগ মার্কেটে। প্রতিবছরই তাই বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের শিকার এই মার্কেটগুলোর নাম রয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের তালিকায়। ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা না থাকাসহ বেশ কিছু অব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি মার্কেটকে বিগত সময়ে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জরিমানাসহ সতর্কও করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। মার্কেট কর্তৃপক্ষ নেয়নি কার্যকর পদক্ষেপ।
আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সঠিক আইন প্রয়োগের অভাবেই বিভিন্ন মার্কেট ও ভবন মালিকরা এসব বিষয়ে অসচেতন থেকে অনিয়মগুলো করছেন।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, চট্টগ্রামের অন্তত ৪৫টি মার্কেট ও ১০টি বাজার আগুনের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বড় বাজারগুলোতে আবার রয়েছে একাধিক মার্কেট। এই মার্কেট ও বাজারগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষ করে রেয়াজুদ্দিন বাজার ও আশপাশের মার্কেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ এখানে একটি মার্কেটের সঙ্গে আরেকটি মার্কেটে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। এসব বাজারে তিনশ’ থেকে চারশ’ মার্কেটই এক ছাদের নিচে। ‘এছাড়া তালিকায় থাকা অধিকাংশ মার্কেট ও বাজারের গলি সরু। পানিও পাওয়া যায় না। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানোও কঠিন। আমরা ব্যবসায়ীদের প্রায় সময়ই সচেতন করি। কিন্তু সচেতন হন না। কেউ হাজার টাকা দিয়ে একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও কেনেন না।’- যোগ করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে, নগরীতে প্রায় ৭ হাজারের মতো বহুতল ভবন আছে। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভবন আবাসিক এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভবনগুলোই সবচেয়ে বেশি আগুনের ঝুঁকিতে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, ফায়ার সেফটির কোনো ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চমাত্রার যেসব বৈদ্যুতিক লাইন রয়েছে সেগুলো খোলা থাকাসহ নানা অনিয়মের কারণে নগরীর ৭০ শতাংশ মার্কেট, বাজার ও বিপণী বিতান উচ্চমাত্রার অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে।
মার্কেটগুলো ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানো কঠিন। অন্যদিকে চার দশকে চট্টগ্রামে বিলীন হয়েছে ২৪ হাজার জলাধার। যে কারণে অগ্নি-নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসকে পানির সংকটে পড়তে হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৯৮১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর ও জলাশয় ছিল। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সবশেষ জরিপে, ৪ হাজার ৫২৩টি পুকুর ও জলাশয় থাকার চিত্র উঠে আসে। তবে সবশেষ ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসের জরিপে বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরের ৪১টি ওয়ার্ডে পুকুর ও দিঘি আছে মাত্র ৬১৫টি।
মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ একথা স্বীকার করে তামাকুমুন্ডি লেন বণিক সমিতির নেতা আহমদ কবির দুলাল বলেন, প্রশাসনের দেওয়া শর্তগুলো দ্রুত পূরণ করে মার্কেটকে নিরাপদ করে তোলা হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, চট্টগ্রামে প্রায় তিন লাখ ভবন আছে। এরমধ্যে ৬-৭ হাজার বহুতল ভবন। গত পাঁচ বছরে যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, সেগুলোতে কিছুটা অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানা হয়েছে। কিন্তু ১০-১২ বছর আগে যেসব বহুতল ভবন বানানো হয়েছে, সেগুলো অগ্নি নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা করেনি। ফলে চট্টগ্রামে বিশাল এক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাই ঝুঁকি এড়াতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।