সুন্দরবনের একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। নামে গোল হলেও এ পাতা গোলাকার নয়, লম্বা। সবুজ বর্ণের এ পাতা অনেকটা নারকেলগাছের পাতার মতো। সুন্দরবনে শুরু হয়েছে চলতি বছরের গোলপাতা আহরণ মৌসুম। গত ২৮ জানুয়ারি বন বিভাগের অনুমতি পেয়ে বর্তমানে গোলপাতা আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাওয়ালিরা। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের দুটি কূপে এখন চলছে গোলপাতা আহরণ। নির্বিঘ্নে গোলপাতা কাটতে পেরে খুশি বাওয়ালিরা। বন বিভাগের কঠোর নিরাপত্তা আর কড়াকড়িতে প্রথম ট্রিপের গোলপাতা কাটতে এখন অধিক ব্যস্ত বাওয়ালীরা। বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গোলপাতা আহরণে বনের অভ্যন্তরে যাচ্ছেন তারা। ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলবে এ মৌসুম। সুন্দরবন থেকে যারা গোলপাতা সংগ্রহ করেন, তাদের বলা হয় বাওয়ালি। প্রতিবছর গোল গাছের পাতা কেটে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন ৪৫০ বাওয়ালি। বন বিভাগের বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী গোলপাতা সংগ্রহ করতে হয়। চলতি মৌসুমে ৫০০ মণ ধারণ ক্ষমতার বড় নৌকা নিয়ে গোলপাতা কাটতে সুন্দরবনে যান খুলনার কয়রা উপজেলার গিলাবাড়ি গ্রামের বাওয়ালি মো: জাহাঙ্গীর। গত বছর গোলপাতা কেটে খরচ বাদে তেমন লাভ পাননি তিনি। গোলপাতা আহরণে তার খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। খরচ বাদে লাভ হয় মাত্র ২০ হাজার টাকা। জাহাঙ্গীর বলেন, এখন আর আগের মতো গোলপাতার চাহিদা নেই। বাওয়ালির (যারা গোলপাতা আহরণ করে বিক্রি করেন) সংখ্যাও কমে গেছে। আমরাই কিছু মানুষ এখনও বাপ-দাদার পেশা ধরে পড়ে আছি। একই উপজেলার নাকশা গ্রামের বাওয়ালি রবিউল সরদার বলেন, ‘সুন্দরবনে আগের মতো বনদস্যুর উপদ্রব না থাকলেও গোলপাতা আহরণের আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়েছে। সে তুলনায় গোলপাতার দাম বাড়েনি। ভাবছি পেশা পরিবর্তন করব। ঘরবাড়ি তৈরিতে গোলপাতার ব্যবহার কমে যাওয়ায় কমে গেছে চাহিদা। এ কারণে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণও কমেছে। লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় পেশা পরিবর্তন করেছেন খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অনেক বাওয়ালি। গোলপাতা ও নিম্নমানের ঢেউটিনের দাম প্রায় একই রকম। এ কারণে লোকজন ঢেউটিন ব্যবহার করছে। গ্রাম এলাকায়ও গোলপাতার ঘর কমে গেছে। বেড়িবাঁধের ওপরে কিংবা নদী-রাস্তার পাশে নিম্ন আয়ের লোকজন এখন গোলপাতা ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু রিসোর্ট ও বাংলো বাড়িতে শোভাবর্ধনের জন্য গোলপাতার ছাউনি দেওয়া হয়। বন বিভাগের খুলনা সার্কেল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণ হয়েছিল ৭ হাজার ৯৯৪ টন। এ থেকে বন বিভাগের আয় ছিল ২১ লাখ ১৯ হাজার ৫৫১ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গোলপাতা আহরণের পরিমাণ কমে ৬ হাজার ৩৪০ টনে দাঁড়ায়, তবে আয় হয় ৩৮ লাখ ৪ হাজার ৩৪০ টাকা। পাস-পারমিট ফি বাড়ায় আয়ও বেড়েছে।
সূত্রটি জানায়, গত ২৮ জানুয়ারি থেকে চলতি মৌসুমে গোলপাতা আহরণ শুরু হয়েছে, যা চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে গোলপাতা আহরণ করেছিলেন ১ হাজার ৩০০ জন বাওয়ালি এবং পূর্ব বন বিভাগে ৪৪১ জন। এই সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয় বছর আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। চলতি বছর গোলপাতা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩০০ টন।
কয়রার পল্লীমঙ্গল গ্রামের বাওয়ালি কামরুল সরদার বলেন, প্রতি কুইন্টাল (১০০ কেজি) গোলপাতা আহরণে বন বিভাগকে রাজস্ব দিতে হয় ৬০ টাকা। সে হিসাবে ৫০০ মণের একটি নৌকায় খরচ হয় ১২ হাজার টাকার মতো। এর পর দু’জন শ্রমিকের মাসিক বেতন দিতে হয় ৪০ হাজার টাকা। তাদের খাওয়া খরচ আছে। আবার চেকিং খরচ লাগে। সব মিলিয়ে নৌকা প্রতি এবার খরচ হবে ১ লাখের বেশি, লাভ হবে সামান্যই।
শরণখোলার মঠেরপাড় এলাকার বাওয়ালি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গোলপাতা আগের মতো এখন বিক্রি হয় না। তার পরও পেশা টিকিয়ে রাখতে প্রতিবছর গোলপাতা কাটতে যাই। এ ছাড়া গোলপাতা আহরণের নৌকা মেরামতেও অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হয়। এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, নির্দিষ্ট সময় পরপর গোলপাতা কাটলে ঝাড়ের বৃদ্ধি ভালো হয়। এতে সম্পদ আহরণও হয়। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেনের মতে, গোলপাতা না কাটলে গোলপাতা ঝাড় বা বনের কোনো ক্ষতি হয় না। পাশেই নতুন ঝাড় গজায়।