খুলনা উপকূলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ
কৃষিতে স্বনির্ভরতার নতুন দুয়ার
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফকির শহিদুল ইসলাম, খুলনা
দেশের অধিকাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। শুধু ভিটামিন এ-এর অভাবে দেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করে। এক্ষেত্রে সামুদ্রিক মৎস্যের জল আয়তনের অর্থনৈতিক এলাকা ৪১,০৪১ বর্গ নটিক্যাল মাইল হতে পারে পুষ্টি নিরাপত্তার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সফল শৈবাল চাষে উৎপাদিত সামুদ্রিক শৈবাল এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। উপকূলীয় অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচন, পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনয়নে শৈবাল চাষ খুলে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার নতুন দুয়ার। পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যোগ করে জনগণের পুষ্টির অভাব পূরণ ও রোগ প্রতিরোধে আগামী দিনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই শৈবাল চাষ। শৈবাল থেকে তৈরি খাদ্যপণ্য, ঔষধি পণ্য, প্রসাধনী পণ্য, সার, বায়ো ফুয়েল ও পরিবেশ দূষণরোধক পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। লবণাক্ত, আধা লবণাক্ত পানিতে এটি জন্মে এবং সহজে চাষাবাদ করা যায়।
সামুদ্রিক শৈবাল বিভিন্নভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রফতানির যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তারা শৈবাল চাষ শুরু করার ফলে যেমন লাভবান হবেন, ঠিক তেমনি শৈবালের চাষও বিস্তৃত হবে। এতে করে অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাবে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সংলগ্ন খুলনার কয়রায় ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দারুণ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সুন্দরবন উপকূলে শৈবাল চাষে নতুন আয়ের পথ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় চাষ সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে পারলে নতুন আয়ের দুয়ার খুলবে। আমাদের দেশে ৮টি প্রজাতি থেকে ২টি প্রজাতির শৈবাল চাষ হচ্ছে।
বর্তমানে শৈবাল থেকে স্যুপ, সবজি বার্গার, সিঙ্গারা, সমুচা, নুডুলস, সালাদ, চাটনি, পাকোড়া, নিমকি, চকলেট, জেলিসহ সাশ্রয়ী মূল্যের পুষ্টিসমৃদ্ধ মানব ও পশুখাদ্য পোশাক শিল্প ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যা সরকারের সমুদ্র অর্থনীতির ব্লু ইকোনমিতে ভূমিকা রাখছে। উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালীর মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রায় দুই বছর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরে বীজ দিয়েছিল। এখানে আমরা ৩০ জন চাষ করি। তেমন কোন কষ্ট নেই। মাঝেমধ্যে রশিতে আবর্জনা বাধলে ছাড়িয়ে দিতে হয়। দুই রকম বীজ দিয়েছিল। এর মধ্যে বারি ১ খুব ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, শৈবাল কাঁচা অবস্থায় আমাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ১২০ টাকা দরে কিনে নেয়। আমি এ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার শৈবাল বিক্রি করেছি। বড় আকারে চাষ করতে পারলে তেমন কোনো পরিশ্রম ছাড়াই বেশ আয় করা যাবে বলে তিনি যোগ করেন। খুলনার কয়রা উপজেলার টেপাখালী গ্রামের বাসন্তী মুন্ডার বলেন, নোনা পানির মাছের ঘেরের মধ্যে রশি টানিয়ে শৈবালের বীজ বেঁধে রেখে দেই। এই শৈবাল পানি থেকে সরাসরি পুষ্টি নিয়ে বাড়ে। এদের কোনো মূল, কান্ড, পাতা, ফুল বা ফল হয় না। এটা দেখতে সেমাইয়ের মতো। তিনি বলেন, সরেজমিন কৃষি গবেষণা বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি বীজসহ যাবতীয় উপকরণের ব্যবস্থা করেছে।
একই উপজেলার ৬নং কয়রা গ্রামের গোলাম মোস্তফা মৎস্য ঘেরের মধ্যে একইভাবে শৈবাল চাষ করছেন। তিনি বলেন, পানির এক ফুট নিচ দিয়ে শক্ত রশি টানটান করে টানানো হয়েছ্।ে বাঁশের সঙ্গে রশি বাঁধা রয়েছে। সেই রশিতে ১৫ সেন্টিমিটার পরপর শৈবালের বীজ বেঁধে দেয়া হয়। কোনো পরিচর্যা ছাড়াই বড় হয়। পরে আমাদের কাছ থেকে রেজমিন কৃষি গবেষণা বিভাগের স্যারেরা নিয়ে যাচ্ছে। শুনেছি এগুলো অনেক কাজে লাগে, মানুষেও খায়। পরীক্ষামূলক সামুদ্রিক শৈবাল চাষ চলছে সুন্দরবন উপকূলীয় শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জের পালবাড়ি। সুন্দরবন উপকূলের প্রায় শতাধিক চাষির ঘেরের নোনাপানির নিচে রশিতে দুলছে নতুন স্বপ্ন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. দেবেষ দাস বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের ল্যাবরেটরির আওতায় স্বল্প পরিসরে একটি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে।
সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি গুড়া করে হারবাল পণ্য হিসেবে মানুষ ব্যবহার করতে পারে। প্রসাধনী তৈরিতেও এটির গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে এটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। শুকিয়ে পাউডার হিসেবে মাটিতে ব্যবহার করলে মাটির পুষ্টি ধারণ ও পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, লবণাক্ততার প্রভাব কমাবে।