চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা
গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে সুন্দরবনের ৩ শতাংশ বনাঞ্চল
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ জলাভূমি সুন্দরবনের আয়তন বেড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে, যা আবাসস্থল বিভাজন এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাসের মতো পরিবেশগত উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। অন্যদিকে সাভানা বনাঞ্চলের পরিমাণ সামান্য কমে ১ দশমিক শূন্য শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে, যা মানবসৃষ্ট অভিবাসন বা প্রাকৃতিক বনের গতিশীলতার কারণে বনের সহনশীলতা কমে যাওয়া এবং সম্ভাব্য অবনতির ইঙ্গিত দেয়। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ২০২৪ সালের ‘রাইজিং টাইডস, রোরিং ফিউচার্স : দ্য সুন্দরবন কোয়েস্ট ফর সার্ভাইভাল’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জলাভূমির আয়তন বাড়ার পরও এই অঞ্চলের ২১০ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, মলাস্কা এবং ঝিনুক ব্যাপকভাবে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে বনাঞ্চলের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে এবং পানির উৎসগুলোতে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে আবাসস্থল বিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত এলাকার যৌথ ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালে সুন্দরবনের ৯৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকা ঘন বনাঞ্চলে আবৃত ছিল, যা ২০২৪ সালে কমে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ গত ৫১ বছরে প্রায় ৩ শতাংশ বানাঞ্চল হারিয়েছে সুন্দরবন। ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ভূমি আবরণে পরিবর্তন ঘটেছে। ঘন বনের পরিমাণ কমে গেছে, আর জলাভূমির আয়তন বেড়েছে। এটি আবাসস্থল হারিয়ে যাওয়া এবং বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়। কার্বন আত্তীকরণ থেকে উপকূল রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সেবা প্রদানকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতান্ত্রিক এলাকার আয়তন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। গবেষকরা অনুমান করছেন, গত ৩০ বছরে সুন্দরবনের বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার, যার ৮০ শতাংশেরও বেশির জন্য দায়ী ম্যানগ্রোভ অবক্ষ।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, সুন্দরবন বর্তমানে যে সব হুমকির সম্মুখীন সেগুলোও সত্তর বিবেচনা করতে হবে, যেমন বাঘের জনসংখ্যা হ্রাস, সুন্দরী গাছের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, সুন্দরবনের মধুর জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি এবং রামপালে কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ। এ বিষয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু ও পরিবেশ নীতি বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান বলেন, সুন্দরবন রক্ষা জরুরি এবং এর জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি একটি সীমান্তবর্তী সমস্যা, তাই ক্ষতি ও ক্ষয়পূরণ তহবিলের আওতায়বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়া স্থানীয়ভাবে দূষণ রোধে কাজ করতে হলে, স্থানীয় পরিবেশ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল্প আয়ের উৎস সরবরাহ করতে হবে এবং এলাকায় দূষণকারীদের সরকারি সুবিধা বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, সুন্দরবনের এমন অবস্থা হয় মূলত প্রাকৃতিক কারণে কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে। আমরা মনে করি, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সুন্দরবনের ভেতর মানুষের দ্বারা কোনো ক্ষতি হওয়া সম্ভব না। তবে কিছু কিছু জায়গায় ভাঙন প্রবণতা আছে। এটা আমরা অস্বীকার করছি না। তিনি আরো বলেন, সুন্দর বনের ভেতর ও পাশ দিয়ে দিয়ে ভারতের কিছু কার্গো জাহাজ চলাচল করে, তাই এর কিছু প্রভাব আছে। তবে এর চেয়ে বেশি হলো ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব।
বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে বহুমাত্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। সমাধান উল্লেখ করে সংগঠনটি জানায়, সুরক্ষিত এলাকা যৌথভাবে পরিচালনা, সমন্বিত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং যৌথ গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে। অবৈধ কার্যকলাপ ও বন্যপ্রাণী চলাচল ট্র্যাক করতে ড্রোনসহ ডিজিটাল মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা ব্যবহার করা যেতে পারে। সেন্সরভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ততার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও সুরক্ষিত এলাকা ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বিস্তার করা অতীব জরুরি। ঐতিহাসিক প্রশাসনিক মডেলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ভূমি ও সমুদ্র রক্ষার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে খুব দ্রুত নবায়ন করা উচিত।