খুলনা বিভাগে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সংকট

৬০ ভাগ হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফকির শহিদুল ইসলাম, খুলনা

একজন রোগীর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয় বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকের (সার্জন) তত্ত্বাবধানে। আর শরীরের প্রয়োজনীয় অংশকে অসাড় অজ্ঞান করার (অ্যানেস্থেসিয়া) মাধ্যমে রোগীকে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতের কাজটি করে থাকেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। এর পাশাপাশি অসাড় অবস্থায় হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যকারিতা ঠিক রাখা অস্ত্রোপচার-পরবর্তী এবং সময়ে রোগীর জ্ঞান ফেরানো ও ব্যথা প্রশমনের কাজটিও করেন তিনি। জরুরি অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি সার্জন অ্যানেডেসিওলজিস্ট দুজনের ওপরই নির্ভর করে। এজন্য গোটা বিশ্বেই স্বাস্থ্য খাতে সার্জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পর্যাপ্ততার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। যদিও খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য খাত চলছে সার্জন ও অ্যানেডেমিওলজিস্টের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট নিয়ে। বিশেষ করে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ সংকট তুলনামূলক বেশি প্রকট।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিভাগে সরকারি হাসপাতালগুলোয় গড়ে সার্জন রয়েছেন একজন। আর গড়ে প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন একজনেরও কম। আবার এসব হাসপাতালে গড়ে প্রতি তিনজন সার্জনের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন মাত্র একজন। রয়েছে ল্যাব টেকনিশিয়ানের মতো জনবলের সংকটও। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবে কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে সার্জারি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট আরো বেশি।

তথ্য মতে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন মাত্র ১৬ জন। এ পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ খালি রয়েছে ৫৯টি। প্রায় ৫৬.৫০ শতাংশ শূন্যপদ নিয়ে খুলনা বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিতে স্বাস্থ্য দপ্তর হিমশিম খাচ্ছে। খুলনায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একজন সার্জনের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন দশমিক ৩৭ জন। সরকারি প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট একজনের কম। একইভাবে অন্যান্য দক্ষ জনবলের ক্ষেত্রেও রয়েছে অপর্যাপ্ততা। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের বিপরীতে সার্জন আছেন ১ দশমিক ২২ জন। আর ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন দশমিক ১৭ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ছয়টি হাসপাতালের জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন একজন। প্রতি হাসপাতালের বিপরীতে গড়ে দশমিক ৭৭ জন প্যাথোলজিস্ট ও বায়োকেমিস্ট রয়েছেন। আর প্রত্যেক প্যাথোলজিস্ট বা বায়োকেমিস্টের বিপরীতে ল্যাব টেকনিশিয়ান আছেন দশমিক ২২ জন। পাশাপাশি রয়েছে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান, অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সংকট। দক্ষ এসব জনবলের অভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় নিয়মিত অস্ত্রোপচার কার্যত্রুমে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে পেশাজীবীদের সংকট ও প্রয়োজন অনুযায়ী সমবণ্টন না থাকায় বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার সরকারির মতো বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মারাত্মক সংকট রয়েছে বলে সূত্রটি জানায়।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে দেয়া তথ্য মতে, খুলনা জেলায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের জন্য মোট পদ রয়েছ ২৫টি। কর্মরত অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র চারজন। শূন্য পদের সংখ্যা ২১টি। মোট ৯টি উপজেলা এবং খুলনা সদরের সরকারি হাসপাতালগুলো পরিচালনার জন্য এ সামান্যসংখ্যক শৈল চিকিৎসক দিয়ে সার্জারি বিভাগ পরিচালনা করা মোটেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন উপজেলায় এটি থাকলেও বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট স্বল্পতার কারণে তারা তড়িঘড়ি ভাবে দায়িত্ব পালন করে অন্য একটি রোগীর কাছে যেতে ব্যস্ত থাকেন। এমন কি বেশী টাকা উপার্যনের জন্য অন্য ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালেও যেয়ে থাকেন। এজন্য রোগীর মৃত্যুও ঘটে থাকে। ২০২০ সালে ২৬ মার্চ নগরীর গরিবনেওয়াজ ক্লিনিকে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ডাঃ দিলিপ কুমার কুন্ডুর স্কুলে সায়লা শারমীন নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। বাগেরহাট জেলায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ আছে সাতটি। চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। শূন্য রয়েছে ছয়টি পদ। সাতক্ষীরা জেলায় পদ রয়েছে ৯টি। চিকিৎসক আছেন চারজন। এখানে জন্য রয়েছে ছয়টি পদ। যশোর জেলায় পদের সংখ্যা চারটি থাকলেও চিকিৎসক আছেন দুজন আর শূন্য রয়েছে দুটি পদ। কুষ্টিয়া জেলায় ৯ পদের বিপরিতে চিকিৎসক আছেন মাত্র দুজন। বাকি সাতটি পদ শূন্য রয়েছে। ঝিনাইদহ জেলায় মোট পদের সংখ্যা আটটি থাকলেও চিকিৎসক আছেন মাত্র দুইজন বাকি ছয়টি পদ শূন্য পড়ে আছে। এছাড়া মাগুরা জেলায় শৈল চিকিৎসকের জন্য আটটি পদ থাকলেও সবগুলোই শূন্য পড়ে আছে। মেহেরপুর জেলায় ৪টিপদের জন্য একজনও চিকিৎসক নেই। চুয়াডাঙ্গা জেলায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের জন্য কোনো পদ নেই। এ জেলায় কোনো প্রকার সার্জারি হয় না। সার্জারির জন্য রোগীদের অন্য জেলায় পাঠানো হয়ে থাকে। শুধুমাত্র নড়াইল জেলায় একটি পদের জন্য একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন। এছাড়া বিভাগের বহু হাসপাতালে প্রায় ৬০ শতাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য পড়ে আছে দীর্ঘদিন। এসব হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসকের পদ খালি আছে ২৫ শতাংশ। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় এ সংকট আরো প্রকট। সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সদের ৭৫ শতাংশেরই পদায়ন হয়েছে শহরাঞ্চলে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জনবল কটনের সঠিক পরিকল্পনা নেই। দেখা যায়, পদ আছে বিশেষজ্ঞ নেই। আবার বিশেষজ্ঞ থাকলেও পদ নেই। চিকিৎসার জন্য কোনো বিষয়ে কত বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন তারও সঠিক পরিকল্পনা নেই। গাইনি বিশেষজ্ঞ ও সার্জনের সংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্তসংখ্যক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নেই। আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা যেমন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও সহযোগী দক্ষ লোকবল নেই। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও ভূমিকা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত কাজের অভাব রয়েছে। এজন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় লোকবল নিয়োগে শক্তিশালী ও উচ্চ পর্যায়ের একটি স্বাস্থ্য কমিশন প্রয়োজন।

অ্যানেস্থে’সিওলজিস্টসহ বিশেষায়িত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট মোকাবেলায় সরকার কাজ করছে জানিয়ে খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ বলেন, প্রতিনিয়তই চাহিদা বাড়ছে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ক্ষেত্রেও আসন সীমিত। নিয়োগের পদ বাড়ানোর জন্য যেমন সরকারের প্রক্রিয়া চলছে, তেমনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে আসন বৃদ্ধির কাজ করা হচ্ছে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে।