মৌসুমের শুরুতে অপরিপক্ব তরমুজ এনে চট্টগ্রামের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করায় ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে তরমুজ বয়কটের ডাক দেয় নেটিজেনরা। পরে ক্রমেই বাজারে সরবরাহ বাড়ায় কমতে থাকে রসালো ফলটির দাম। তবে বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের আড়তগুলোতে জমে উঠেছে তরমুজের পাহাড়। হাটবাজার, অলিগলির ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে ফলের দোকানে তরমুজ আর তরমুজ। তবে হাসি নেই তরমুজ ব্যবসায়ীদের মুখে। এমনকি চাষির মুখেও নেই হাসি! কারণ বাজারে তরমুজ খাওয়ার মতো এখন ক্রেতা নেই। গতকাল সকালে নগরীর চিটাগাং ফার্ম, আল্লাহর অলি হাফেজ নগর ফার্ম, মদিনা ফার্ম, শাহজালাল এন্টারপ্রাইজ, বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, আমানত ফার্ম, ঢাকা ফার্ম, বোয়ালখালী ফার্ম, নোয়াখালী ফার্ম, পরান ট্রেডার্স, ইসলাম ট্রেডার্স, রহমান ট্রেডার্স, আল মক্কা ফার্ম, নাজিম ট্রেডার্স, আল্লার দান ফার্ম ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এসব আড়তে নোয়াখালী, রাঙামাটি, ভোলা, বরিশাল, খুলনা থেকে নিয়মিত তরমুজ আসছে। এদিন সকালে ফিরিঙ্গিবাজারের আড়তে সুবর্ণচরের চাষি আকরাম জানান, তিনি ১৫ হাজার টাকায় কাভার্ডভ্যান ভাড়া দিয়ে আড়াই হাজার ছোট বড় তরমুজ আড়তে এনেছিলেন আনেন। জায়গা খালি না থাকায় আড়তের সামনেই তরমুজ বোঝাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখেন।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে বেশি দামের আশায় কিছু চাষি অপরিপক্ব তরমুজ বাজারজাত করেছিল। আকারে বড় হলেও ভেতরে ছিল সাদা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবার তরমুজের বাজারে। তবে এখন বেশিরভাগ তরমুজই পরিপক্ব এবং ভেতরে লাল ও মিষ্টি। তিনি বলেন, আট কানি জমিতে আমি তরমুজ চাষ করেছি এবার। গোল হরি বীজ ৬-৭ হাজার টাকা, জাম্বু বীজ ২ হাজার ৬০০ টাকা, বাংলালিংক তরমুজের বীজের প্যাকেট ১২০০-২০০০ হাজার টাকা। মোটর দিয়ে দুইবার পানি সেচ দিছি। কলের লাঙল দিয়ে জমি চাষ দিয়েছি। ৬০০ টাকা দরে দিনমজুর দিয়ে জমিতে চার হাত পর পর বীজের গর্ত করেছি। এক গর্তে তিনটি করে বীজ দিয়েছি। কানিপ্রতি ২০ হাজার টাকা ওষুধ খরচ গেছে। সার খরচ গেছে প্রচুর। এখন তরমুজ তোলার জন্য ৬০০ টাকা দামের দিনমজুর দিছি। তাদের এক বেলা খাওয়াতেও হয়। ১৫ হাজার টাকা গাড়িভাড়া দিয়ে প্রথমবার আড়তে আনলাম তরমুজ। আশানুরূপ দাম নেই। ক্রেতা কম। তিনি বলেন, তরমুজের আকার ভেদে ১ থেকে ৪ নম্বর ভাগ করা হয়। ১০০টি বড় তরমুজ ১৬-২০ হাজার টাকা। সবচেয়ে ছোট তরমুজ প্রতিশ’ ৩ হাজার টাকা। আড়তদারের কমিশন ১০ শতাংশ। লেবারদের দিতে হয় তরমুজ প্রতি ৩ টাকা। সব খরচ বাদ দিলে চাষের খরচও হয় না। সুবর্ণচর থেকে কাভার্ডভ্যানে তরমুজ নিয়ে এসেছেন চালক মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, তরমুজের মৌসুম ঘিরে সেখানে একশ্রেণির দালালের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। ১৫ হাজার টাকা গাড়িভাড়া করে ৩ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে। আমাকে দিয়েছে ১২ হাজার টাকা। সরকারি প্রকল্পের পণ্য নিয়ে ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। ফেরার পথে জোর করে তরমুজের ভাড়া গছিয়ে দিয়েছে। গত মঙ্গলবার ইফতারের সময় রওনা দিয়েছিলাম। আড়তে পৌঁছায় রাত দেড়টায়। এখনও তরমুজ নামানো হয়নি গাড়ি থেকে। রাঙামাটি থেকে এক ট্রাক তরমুজ নিয়ে ফিরিঙ্গিবাজার আড়তে এসেছিলেন আবদুর রহমান। তিনি জানান, আড়াই হাজার তরমুজ এনেছি। ভাড়া দিয়েছে ১৪ হাজার টাকা। সকাল ১১টায় রওনা দিছি, বিকেল সাড়ে ৩টায় ফিরিঙ্গিবাজার। বায়েজিদ এলাকায় খুচরা তরমুজ বিক্রি করেন মো. হারুন। তিনি বিভিন্ন আড়তে ঘুরে তরমুজ দেখছিলেন। তিনি বলেন, ১০০ তরমুজ কিনলে ১০টি পচা, ভেতরে সাদা পড়বেই। তাছাড়া আড়তদারি দিতে হয় ৩০০ টাকা, লেবার চার্জ ১০০ টাকা। সিএনজি বা পিকআপ ভাড়া ৪০০-১০০০ টাকা।
তারপরও শাস্তি নেই। ক্রেতারা ন্যায্য দামই দিতে চায় না। শুধু ফিরিঙ্গিবাজারের আড়তে নয়, স্টেশন রোডের ফলমন্ডির সামনে ফ্লাইওভারের নিচে, বহদ্দারহাট, সিইপিজেড, কাপ্তাই রাস্তার মাথার কামালবাজারসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে তরমুজের স্তূপ দেখা গেছে। কিন্তু বিক্রেতারা বলছেন ক্রেতা নেই বাজারে। চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট কাচা বাজারের সামনে ফল বিক্রেতা কামাল উদ্দিন বলেন, রোজার শুরুতে তরমুজ কিনে অনেকে ঠকেছে।
দামও বেশি দিয়েছে। আর এখন দাম কমলেও তরমুজের ক্রেতা নেই। অথচ তরমুজ এখন পরিপক্ব, ঠকঠকে লাল। অনলাইনে তরমুজের দাম বেশি বলে প্রচার করায় ক্রেতারা তরমুজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের আড়ত ঢাকা ফার্মের ব্যবস্থাপক তানজিদ বলেন, ক্রেতা না থাকায় বিক্রেতারা যেমন ভালো নেই, তেমনি তরমুজ চাষিরা ভালো নেই। কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, খরা, পোকা, শিলাবৃষ্টি, পরিবহন সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতা জয় করে তরমুজ ফলান তারা। কিন্তু ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অনেকে দাদন নিয়ে যান, আর ফেরেন না।