ঢাকা ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খুলনার উপকূলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

খুলনার উপকূলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

খাবার পানির খুব কষ্ট। কারা যেন পাশের গিরামে এট্টা মেশিন বসাই দিসে। নুনা পানি মিষ্টি হয়। আজব দুনিয়া। স্যান্তে পানি কিনে আইনি খাই। পাঁচ টাকা কলস আর আনতি ভ্যানে দিত্যায় পাঁচ টাকা। গরিব মানুষ। গরমে মন ভরে পানি খাইত পাইন্নে’। অনেকটা ভারাক্রান্ত মনে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের মাদারবাড়িয়া গ্রামের কারিমা খাতুন। একই সুরে সুর মিলিয়ে বাগালি ইউনিয়নের চটকাতলা গ্রামের গৃহিণী নাসরিন বলেন, ‘পানি ভাল্লাগে না, মিষ্টি না, আমরা খ্যাতি পারি না, জম্মের লবণ। পানি আন্তি মিলা দূর যাতাই। কলের পানি নুন, আমরা মেলা খাইত পারি না। গরমে পুকুরে পানি নুন হয়, বৃষ্টির সময়ে আমরা মিষ্টি পানি খাই’। পাইকগাছা উপজেলার শান্তা গ্রামের বাসিন্দা শাফায়েত হোসেন বলেন, তীব্র গরমে খাবার পানির পুকুরগুলোও শুকিয়ে গেছে। বাড়ির গৃহিণীসহ অন্য সদস্যরা কলস নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করেন। চারপাশে পানি থাকলেও খাবার উপযোগী পানি নেই কোথাও, সবই লবণাক্ত। খুলনার মতো বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় বিভিন্ন উপজেলায় এখন তীব্র পানি সংকট চলছে। বাগেরহাটের উপকূলীয় মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় নলকূপ ও গভীর নলকূপ অকার্যকর হয়ে গেছে। নদী-খালের মতো নলকূপের পানিতে লবণাক্ততার কারণে লোকজন সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখেন খাবার জন্য। সেই পানি ফুরিয়ে গেছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে সুপেয় পানির হাহাকার চলছে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা; আর শুকনা মৌসুমে এক কলস পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে- কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ। বেশির ভাগ পরিবারে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব থাকে নারীর কাঁধে। সংসারের সব কাজ শেষ করে নারীকে ছুটতে হচ্ছে পানি সংগ্রহে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপদের পাশাপাশি উপকূল অঞ্চলের অনেক স্থানে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বহু গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। উপকূলের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছে। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছে। যারা এসব উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। জলাবায়ু পরিবর্তন, পানির প্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দিন দিন বাড়ছে উপকূলীয় এলাকার নদী ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ। বাড়ছে লবণাক্ত এলাকাও। আর তাতে এসব এলাকায় ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। এতে হুমকির মুখে পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তাসহ সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। এ অবস্থায় লবণ সহিঞ্চু ফসল উৎপাদনে গবেষণাসহ মিষ্টি পানির আধার তৈরির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, জমিতে ৪ ডিএস/মিটার লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনের জন্য স্বাভাবিক ধরা হয়। তবে তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাইকগাছায় জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল গড়ে প্রতি মাসে ১১ ডিএস/মিটার। কোথাও কোথাও লবণাক্ততা ১৭ ডিএস/মিটার পাওয়া যায়। অন্যদিকে এসব এলাকায় নদীতে লবণাক্ততার গড় ১৬ ডিএস/মিটারেরও বেশি। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লবণাক্ততার তীব্রতায় উপকূলীয় এলাকায় আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি, কমছে ফলন। নতুন নতুন জমি লবণাক্ত হচ্ছে প্রতিবছর। অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে উপকূলীয় এলাকায় লবণ সহিঞ্চু ফসলের জাত উদ্ভাবন, মিষ্টি পানির আধার তৈরি, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধসহ নানা পরামর্শ দেন তিনি। গতকাল রোববার বিকালে খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বলেন, আমরা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং বিলি করা শুরু করেছি। আমার নির্বাচনি এলাকায় তো অনেক লোক। সুপেয় পানির সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি আশ্বস্ত করেছেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) শুভেচ্ছা দূত ও সুইডেনের ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া কয়রায় সফর করার সময় তার সঙ্গে কথা বলেছি তিনিও আশ্বস্ত করেছেন। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের যে লজিক প্রজেক্টের মাধ্যমে উপকূলের সুপেয় পানির অনেকটা অভাব পূরণ করা যাবে। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি নিরাপদ নয়। একমাত্র বৃষ্টির পানিই নিরাপদ। সারা বছর মানুষ যাতে বৃষ্টির পানি ধারণ করে রাখতে পারে সে ধরনের একটি ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত