তাপপ্রবাহে ধানে চিটা বেড়েছে

দক্ষিণাঞ্চলের বোরো চাষিদের মাথায় হাত

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি মৌসুমে তিন একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হারতার বাসিন্দা সুভাষ হালদার। ফলনও ভালো পেয়েছেন। কিন্তু ধান কাটতে গিয়ে মিলেছে বিপত্তি। খেয়াল করে দেখেন অধিকাংশ ধানে চিটা। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। সুভাষ হালদার বলেন, ফলন ভালো হলেও চিটা হওয়ায় আমার সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেল। ধান বিক্রি করেই ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিতাম। এখন ভাবছি কীভাবে লোকসান পুষিয়ে উঠব। সুভাষ হালদারের মতো অনেকের ধানখেতে ধরা দিয়েছে চিটার দুঃসংবাদ। চলতি মৌসুমে বোরো চাষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও চিটার আধিক্যের কারণে লোকসানের মুখে পড়বেন কৃষকরা।

কৃষিবিদরা বলছেন, তীব্র দাবদাহের কারণে ধান পরিপক্ব হওয়ার আগেই শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বিভাগে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৩০২ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে বরিশালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৩ হাজার ১৫০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ৬৩ হাজার ২৫০ হেক্টর; ভোলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৩ হাজার ১০০ হেক্টর, আবাদও ৬৩ হাজার ১০০ হেক্টর; পটুয়াখালী জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর, আবাদ হয় ২১ হাজার ৬০০ হেক্টর; বরগুনা জেলায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় ১০ হাজার ৫৫২ হেক্টর, আবাদ হয় ১৪ হাজার ৪১ হেক্টর; পিরোজপুর জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪ হাজার হেক্টর জমি, আবাদ হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১০ হেক্টর এবং ঝালকাঠি জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিটা হয়েছে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর, মঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানি, বরগুনা জেলার তালতলী, বেতাগী, আমতলী, পটুয়াখালীর সদর, খেপুপাড়া, দুমকি, দশমিনা, গলাচিপা উপজেলায়, ভোলা জেলার সবগুলো উপজেলায় চিটার পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া ঝালকাঠি জেলার সদর, নলছিটি, রাজাপুর, কাউখালি উপজেলায় এবং বরিশালের সদর, উজিরপুর, বানারীপাড়া, বাবুগঞ্জ, হিজলা উপজেলায় বোরো ফলনে চিটার পরিমাণ বেশি। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোড় ইউনিয়নের কৃষক মোতালেব হাওলাদার বলেন, বোরো ফলন ভালো হলেও চিটার পরিমাণ বেশি। খেতের এক-তৃতীয়াংশ ধানে চিটা দেখা যাচ্ছে। আমার জমি নিচু হওয়ায় আবাদে দেরি হয়েছে। ফলন আসতে আসতে অতিরিক্ত গরমে পড়েছে। এজন্য চিটা বেড়েছে। চাষের খরচ উঠলেও আমার লাভ চিটা হয়ে গেছে। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার চাষি ইউসুফ খলিফা বলেন, ধান পাকতে রোদ খুব উপকারী। কিন্তু এবার রোদের সঙ্গে এত বেশি গরম হয়েছে যে ধান পাকার আগে শুকিয়ে গেছে। আমি কৃষিকাজ করছি ৩০ বছরের বেশি। এবারই দেখলাম এত বেশি চিটা জমিতে। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাচড়া ইউনিয়নের কৃষক আবু হানিফ মোল্লা বলেন, কৃষি অফিস থেকে বলা হয়েছিল গরমে ধানখেতে ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার পানি জমিয়ে রাখতে। ভোলা দ্বীপ জেলা হলেও এখানে চাষাবাদের পানির সংকট আছে। এজন্য অনেকেই জমিতে পানি রাখতে পারেনি। যে কারণে ধানের মোচড়া বেড়িয়েও তা চিটা হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনার অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ এসএম বদরুল ইসলাম বলেন, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বোরো খেতের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু এর বেশি হলে অপরিপক্ব ধানগুলো শুকিয়ে চিটা হয়ে যেতে পারে। ধানের দুধ ও ক্ষীর অবস্থায় তাপমাত্রা বাড়লে শিষের ক্ষতি করে। পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, পটুয়াখালীতে কিছু জমিতে চিটা দেখা গেছে। তারপরও আমরা হেক্টর প্রতি সাড়ে ৬ থেকে ৭ মেট্রিক টন ধান পেয়েছি। যাদের জমির ধানে চিটা দেখা দিয়েছে তারা মেষের দিকে জমি চাষ করেছে। এজন্য অধিক তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যখন থেকে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে তখন থেকেই কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জমি শীতল রাখতে ৫/৭ সেন্টিমিটার পানি জমিয়ে রাখার জন্য। ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওযারিসুল কবির বলেন, ভোলার বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও এই জেলায় চাষাবাদের পানির সংকট থাকায় চিটা তুলনামূলক বেশি হয়েছে। পানির সংকট থাকায় কৃষকরা তাদের জমি শীতল রাখতে না পারায় চিটা বেশি হয়ে খুব ক্ষতির মুখে পড়েছে। পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ফ্লাওয়ারিং স্টেজে ৩৫ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা বাড়লে ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়। জেলার নাজিরপুর, মঠবাড়িয়াসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে চিটা বেশি হওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। মোট ধানের ১৫ শতাংশ যদি চিটা হয় তাহলে তা ক্ষতি বিবেচনা করা হয়। সাধারণত ৫/৭ শতাংশ চিটা হবেই। কৃষকরা আমাদের কাছে বলেছেন, সাধারণের চেয়ে এবার চিটার পরিমাণ বেশি। চিটার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এদিকে ঝালকাঠি ও বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, দাবদাহের মধ্যেই ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। ৩/৪ দিনে শতভাগ ধান কাটা হয়ে যাবে। অনেক স্থানে শ্রমিক সংক থাকায় তারা কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। উল্লেখ্য, আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে, সারা দেশের মতো বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়েও তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এবার ৪৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় কলাপাড়া উপজেলায়। এ ছাড়া বরিশালের জেলাগুলোতে ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।