তাপপ্রবাহের অস্বস্তির মধ্যে বৃষ্টির আভাস

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

আরামপ্রদ আবহাওয়া ছিল গত কয়েক দিন। তাপপ্রবাহ কমে যাওয়ায় স্বস্তিতে ছিল মানুষ। কিন্তু জ্যৈষ্ঠের প্রথম দিন থেকেই আবার শুরু হয় তাপপ্রবাহ। গরমও পড়ছে ভীষণ। ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেই নিদারুণ অস্বস্তি। এমনকি ঘরের ফ্যানের বাতাসও যেন আগুনের হল্কা। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হচ্ছে। তীব্র গরম আর ঘামে নাস্তানাবুদ অবস্থা সবার। তাপপ্রবাহে নাকাল শ্রমজীবী মানুষ। প্রচণ্ড এ গরমে কিশোরগঞ্জে ৩০ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর সিলেট ও ঢাকায় দুজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে চরমভাবাপন্ন অবস্থায় আবহাওয়া বিভাগ রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বিভাগে আবার ৪৮ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরেই রয়েছে দিনাজপুরে ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রংপুরে ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাঙামাটিতে ৩৮ দশমিক ৫, সীতাকুণ্ডে ৩৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সব জেলায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো জেলার মানুষ স্বস্তিতে নেই।

প্রচণ্ড গরমের কারণে কাজ ছাড়া তেমন বের হয়নি ঢাকা শহরের মানুষ। রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি অন্যদিনের তুলনায় কম মনে হয়েছে। গরমে সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে রয়েছেন রিকশাচালক, ভ্যানচালক, মুটে মজুর, ভাসমান হকার, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ আর আনসার সদস্যরা। জীবিকার তাগিদে চরম গরম উপেক্ষা করে কাজ করতে হয়েছে অনেকেই। অনেক রিকশাচালককে গাছের ছায়ার ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। ছায়ার খোঁজে অনেকে এখানে-সেখানে বিশ্রাম নিয়েছেন। রাস্তার পাশে লেবুর শরবত নিয়ে দোকানিদের ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমাগম ছিল ফুটপাথের এসব দোকানে।

এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার রাস্তায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে আবু তালেব (৫০) নামে আনসারের এক প্লাটুন কমান্ডারের (পিসি) মৃত্যু হয়েছে। নিউমার্কেট সিটি কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি মারা যান।

বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে অচেতন অবস্থায় দোকান কর্মচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মো. বেলাল নামে এক দোকান কর্মচারী জানান, দুপুর সোয়া ২টার দিকে নিউমার্কেট এলাকার চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তা দিয়ে তিনি যাওয়ার সময় দেখেন রাস্তায় পড়ে আছেন ওই ব্যক্তি। তখন তিনি তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। খবর পেয়ে হাসপাতালে আসা আবু তালেবের চাচাতো ভাই শরিফুল ইসলাম জানান, তার ভাই শাহবাগ থানার অধীনে আনসার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। তাদের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুরা থানার চরপাড়া গ্রামে। আবু তালেবের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী ও সন্তানরা গ্রামে থাকেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুল হোসাইন জানান, ওই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে তার মৃত্যু হিটস্ট্রোকে হয়েছে কি না ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, নিউমার্কেট এলাকায় আবু তালেব মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। এছাড়া গরমে মাথা ঘুরে পড়ে সিলেট নগরীতে এক ব্যক্তি মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন সময়ের আলোর সিলেট প্রতিনিধি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে তীব্র গরমে নগরীর জিন্দাবাজারে মো. শফিকুল ইসলাম (৩৫) নামে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তিনি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার নয়াগ্রামের আবু আহমেদের ছেলে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কল্লোল গোস্বামী বলেন, আমরা খবর পেয়ে সিটি সেন্টারে গিয়ে ওই ব্যক্তিকে পাইনি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তথ্য পাইনি।

নগরীর শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ওই ব্যক্তিকে আমাদের এখানে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসেন পরিবারের লোকজন। পরিবারের সদস্যরা আমাদের শুধু বলেছেন, মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, হাঁটা অবস্থায় কেউ পড়ে মারা গেলে তাকে হিটস্ট্রোক বলা যাবে না। ওই লোক মাথা ঘুরে পড়ে মারা গেছেন। এদিকে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় সিলেটে রেকর্ড করা তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ বছরের মধ্যে সিলেটে সর্বোচ্চ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত কয়েক দিন কম-বেশি বৃষ্টি ও বৈশাখী ঝড়ের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশেই তাপমাত্রা কিছুটা সহনীয় ছিল। তবে বৈশাখের শেষ আর জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই সারা দেশে বইতে থাকে তাপপ্রবাহ। আর বাতাসে জলীয় বাস্প বেশি থাকার কারণে বেড়েছে অস্বস্তি। কবে বৃষ্টি হতে পারে-এ প্রশ্নে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানান, আজ সিলেট বিভাগের কোনো কোনো স্থানে অস্থায়ীভাবে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হতে পারে। আর আগামীকাল শনিবার ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বৃষ্টি হতে পারে। এতে তাপপ্রবাহ কিছুটা প্রশমিত হবে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহ শেষে আগামী ২১ মের পর সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি পূর্ণ রূপ নিলে এর নাম হবে ‘রেমাল’। ওমানের দেওয়া এ আরবি নামের অর্থ হচ্ছে ‘বালু’। তিনি আরও জানান, আগামী দুদিন বিক্ষিপ্তভাবে দেশের পাঁচ বিভাগে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইবে। ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন মডেল পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানান, ২১ মের পর দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে একটা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হতে পারে, যা পরে লঘুচাপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটির গতিপ্রকৃতি এখনও স্পষ্ট নয়। লঘুচাপ সৃষ্টির পর বলা যাবে। ভারতের আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী এ মাসেই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হতে পারে ঘূর্ণাবর্ত। এরপর তা ক্রমে শক্তি বাড়িয়ে আগামী ২৪ মে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। পরদিন সন্ধ্যার পর তা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে। কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ পিএইডি গবেষক মোস্তফা কামাল জানান, এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড় নিম্নচাপ বা লঘুচাপ সৃষ্টি হয়নি। তাই বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি ২ মের পর সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি প্রধান উপাদানের মধ্যে ইতিমধ্যে তিনটি উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে।