ড্রামের খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবদেক

আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার অন্যতম একটি প্রধান পণ্য ভোজ্যতেল। ভোজ্যতেল খাদ্যপণ্য বিধায় এটি নিরাপদভাবে প্যাকেজিং, মোড়কাবদ্ধ ও লেভেলিং করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপকরণ দিয়ে তৈরি প্যাকেট বা পাত্রে ভোজ্যতেল বাজারজাত না করার বিধানও রয়েছে। তবে খাদ্যমানবিহীন ড্রামে তেল পরিবহন করায় তেলের গুণগতমান ঠিক থাকে না। এসব তেলের ড্রাম পরিষ্কার না করেই বারবার ব্যবহারে মারাত্মক রোগ জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।

ভোজ্যতেল ড্রামে বাজারজাতকরণ বন্ধ করা এবং এর পরিবর্তে বিভিন্ন আকৃতির ফুড গ্রেডেড পাউচ প্যাকে (প্লাস্টিক বোতল, পলিপ্যাক, প্লাস্টিক ফয়েল ইত্যাদি) ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বিষয়ে ২০২১ সালে অংশীজনদের নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একাধিক সভা হয়। ওই সভাগুলোতে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক এক নির্বাহী আদেশে ১৬ মার্চ ২০২২ তারিখের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর ননফুড গ্রেডেড ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাত ও পরিবহন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়। তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতির ঘাটতি বিবেচনায় শিল্প মন্ত্রণালয় এ সময়সীমা বৃদ্ধি করে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২ জুন এ জারিকৃত নির্দেশনায় খোলা সয়াবিন তেল বাজারজাতকরণের সময়সীমা ৩১ জুলাই এবং খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণের সময়সীমা একই সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ সময় সীমার পর শতভাগ ভোজ্যতেল ফুডগ্রেড বোতল-প্লাস্টিক ফয়েল-পাউচপ্যাকে বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে বলা হয়। যা এখনো কার্যকর হয়নি। শিল্প মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. শামীমুল হক বলেন, খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ কবে থেকে কার্যকর হবে সে বিষয়ে এ মাসে একটা মিটিংয়ের তারিখ ছিল, তবে সেটা এখনো হয়নি। আশা করছি, কোরবানির ঈদের পরে মিটিংয়ে খোলা ভোজ্যতেল বাজারে বিক্রি বন্ধের একটা সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে।

ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে রাতকানা রোগ, চোখের শুষ্কতা ও কর্নিয়ার ক্ষতি, ইনফেকশন, দেহের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে থাকে। পাশাপাশি ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতা মানবদেহে পুষ্টির ঘাটতি ঘটায় এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ড্রামের খোলা ভোজ্যতেল মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর জানতে চাইলে লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি অ্যাডভোকেসি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল বলেন, খোলা ভোজ্যতেল ক্যামিকেলের ড্রামে ভর্তি করে বিক্রি করা হয়। একই ড্রাম বারবার ব্যবহার করা হয়। ড্রামের মুখ অনেক ছোট থাকায় ভালোমতো পরিষ্কার করাও প্রায় অসম্ভব।

তাই এসব ড্রামে ক্যামিকেলের অংশবিশেষ থেকেই যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি, যা অল্প পরিমাণের হলেও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যেকোনো ক্যামিকেলে কিডনি, হৃৎপিণ্ড ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে। মানবদেহে ভিটামিন ‘এ’ এর স্বল্পতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি নীরব মহামারি আকারে ধরা পড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলে এ প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় থেকে জানা যায়, ভারতে ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতার হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৬২ শতাংশ প্রাক-স্কুল শিশু ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে ভুগছে এবং এর ফলে বছরে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায়ও এ সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশও ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতাজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকোপ থেকে মুক্ত নয়। জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১৯-২০ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি দুইজনে একজন শিশু ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতায় ভুগছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনিস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ২০১৮ থেকে জুন, ২০২১ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৯১৩টি (বোতল- ৫২০টি, ড্রামণ্ড ৩৯৩) নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা করা হয়, যেখানে অধিকাংশ (৮৭ শতাংশ) বোতলজাতকৃত তেলে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেলেও ড্রামে বাজারজাতকৃত তেলে এটি পাওয়া গেছে মাত্র ৫২.৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৪৭.৩৩ শতাংশ ড্রামে বাজারজাতকৃত তেলেই ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি, যা উদ্বেগজনক। আইসিডিডিআরবি পরিচালিত এক গবেষণায় থেকে জানা যায়, বাজারে প্রাপ্ত খোলা ভোজ্যতেলের ৫৯ শতাংশ নমুনায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি। এক-তৃতীয়াংশ নমুনায় পরিমিত মাত্রার চেয়ে কম ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেছে। মাত্র ৭ শতাংশে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মানদ- অনুসরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সাইন্স অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র নিউট্রেশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান ড. শারমিন আক্তার বলেন, ভিটামিন এর স্বল্পতায় আমাদের বিভিন্ন ধরনের স্কিন ডিজিজ হতে পারে। রাতকানা রোগসহ চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতায় বাচ্চা পরবর্তীতে চোখে কম দেখতে পারে। এছাড়া ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তিনি আরো বলেন, ভোজ্যতেল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমরা ধনী গরিব নির্বিশেষে সবাই খাবারে তেল ব্যবহার করি। সুতরাং ভোজ্যতেলে যদি ফর্টিফাইড করে ভিটামিন এ মিশিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে যেসব শারীরিক সমস্যাগুলো হতে পারে কিংবা এরই মধ্যে হচ্ছেও সেসব জটিলতা কমে আসবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতাজনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ করা এবং দেশের জনগণকেও নিজেদের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খোলা ভোজ্যতেল ব্যবহার না করার পরামর্শও দেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।