ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মেট্রোরেল ছাড়া ফের ভোগান্তিতে নগরবাসী

মেট্রোরেল ছাড়া ফের ভোগান্তিতে নগরবাসী

মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী ফারুক আলমের গন্তব্য কারওয়ান বাজার, অল্প সময়ে অফিস যাওয়ার জন্য সকাল ৮টার দিকে তাকে একের পর এক বাইকারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল। মিরপুরের পল্লবী স্টেশনে বাইক রাইডাররা তার কাছে ভাড়া চাচ্ছিলেন আড়াইশ’ টাকা, তিনি ২০০ টাকা দিতে চাওয়ার পরও কেউ রাজি না হওয়ায় বাসে করে চলে যান ফারুক। এখান থেকে মেট্রোরেলে কারওয়ান বাজার যেতে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বেসরকারি চাকরিজীবী ফারুক আলম বলেন, তার অফিস শুরুর সময় সোয়া ৯টায়; মেট্রোরেল যখন চালু ছিল তখন তিনি বাসা থেকে বের হতেন ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে।

‘তখন ৯টা ৫ বা ১০ এর মধ্যে চলে যেতাম। এখন দুই ঘণ্টা আগে বের হলেও যেতে পারছি না, আরো এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে। এত মানুষের চাপ, গাড়ি পাওয়া কষ্ট হয়ে যায়। গরমের মধ্যে অসহ্য লাগছে।’ শুধু সময় নয়, খরচ নিয়েও চিন্তিত ফারুক বলেন, ‘এখন দিনে ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হচ্ছে, বাইকে সাধারণত দেড়শ’ টাকায় চলে যাওয়া যায়। মেট্রো না থাকায় তারাও বেশি ভাড়া চাচ্ছে, আমি যতই বেতন পাই না কেন; এভাবে তো সম্ভব না চলা।’ ২০২২ সালে মেট্রোরেল চালুর পর থেকে এই পথে যাত্রী সংকটে বাসের সংখ্যা কমতে থাকে; এখনও যাত্রীর তুলনায় বাস কম থাকায় যাতায়াতে আরো ভুগতে হচ্ছে বলে জানালেন ফারুক খান।

তিনি বলেন, ‘সরকার মেট্রোরেল দ্রুত খুলে দিলে জনগণের সুবিধা হত; এটা খুব প্রয়োজন।’ গত ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির মধ্যে মেট্রোর লাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়। সেই আগুনের মধ্য দিয়েই একটি ট্রেন ছুটে যায়। পরে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় একদল মানুষ। তারা টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ওইদিন পল্লবী ও ১১ নম্বর স্টেশনেও হামলা হয়। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে ১ বছর সময় লেগে যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক।

কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক যন্ত্রপাতিই মেরামতযোগ্য অবস্থায় নেই। এগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে। আর এই ট্রেন বন্ধ থাকায় আড়াই লাখের বেশি যাত্রীকে ফিরে যেতে হয়েছে ১ বছর আগের সেই ভোগান্তির জীবনে। গতকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের পল্লবী স্টেশন থেকে শেওড়াপাড়া স্টেশন পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেল, অফিসগামী যাত্রীদের কেউ কেউ দৌড়ে বাসে উঠছেন, কেউ বাইক রাইডারের সঙ্গে দর কষাকষি করছেন, কেউ আবার অটোরিকশায় করে যাচ্ছেন। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে সময় মতো অফিসে পৌঁছাতে পারা নিয়ে অস্থিরতা দেখা যায়, এদিন সকালে ঢাকার রাস্তায় যানজটও ছিল অনেক বেশি। যাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর দীর্ঘদিন ধরে তারা স্বস্তির যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন; পুরোনো অভ্যাসে ফিরতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না; তার সঙ্গে অর্থ ও সময় দুইই খরচ হচ্ছে। শেওড়াপাড়া থেকে নাবিস্কোতে নিয়মিত যাতায়াত করেন বেসরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তা তানজিলা ইয়াসমিন। অফিসে যাওয়ার জন্য তিনি মেট্রোরেলে শেওড়াপাড়া স্টেশন থেকে ফার্মগেট গিয়ে নামতেন; এরপর বাকি পথ যেতেন রিকশায়। মেট্রো বন্ধ থাকায় তাকে অটো রিকশায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। তানজিলা বলেন, মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ার পর তাকে হাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে; সঙ্গে বেড়েছে খরচ। ‘ঘর থেকে বের হলেই মেট্রো স্টেশন, আধা ঘণ্টা আগে বের হলেই চলে যেতে পারতাম। এখন জ্যামে বসে থাকতে হয়। ৪০ টাকার জায়গায় খরচ হচ্ছে ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা। আরামদায়ক একটা সেবায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, এখন আবার পুরোনো ভোগান্তিতে ফিরে যেতে হলো।’ মেট্রোরেলে হামলার ফলে উদ্বেগেও ভুগছেন তানজিলা। তিনি বলেন, ‘হয়তো কয়দিন পড়েই আমার স্টেশন চালু হয়ে যাবে; কিন্তু এই ঘটনা এমন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে; মেট্রোরেলেও নাশকতা হতে পারে, যে ভয়টা আগে ছিল না।‘ হামলাকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি। মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মতিঝিলে যাবেন বেসরকারি চাকরিজীবী পাভেল মাহমুদ। তিনি কয়েকজন বাইক রাইডার এবং অটো রিকশা চালকের সঙ্গে দর কষাকষি করলেন। বাইক রাইডাররা তার কাছে ভাড়া চাচ্ছিল সাড়ে ৩০০ টাকা, আর অটোরিকশা চালক ৪০০ টাকা। পরে তিনি ৩২০ টাকায় বাইকে করে অফিসে যান। পাভেল বলেন, এমন পরিস্থিতি আরো কিছুদিন চলতে থাকলে তাকে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ‘মেট্রোরেলের কারণে শুধু ওই চাকরিটা করি, এখন অফিসে সময় মতো পৌঁছাতে পারি না; জ্যামে বসে থাকতে হয়- এমন পরিস্থিতিতে আছি। আগে আধা ঘণ্টা, ৪৫ মিনিট আগে বের হলে চলে যেতে পারতাম। এখন তিন ঘণ্টা আগে ঘর থেকে বের হতে হয়, আমাদের রুটিন; ঘুম সব কিছুতে এর প্রভাব পড়ছে।’ দ্রুত মেট্রোরেল খুলে দেওয়ার পাশাপাশি যারা স্টেশনে হামলা চালিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান পাভেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো ঘটনা। সবার ভালো ছিল, এই কাজটা কেমনে করল মানুষ! আশপাশের সিসিটিভির ভিডিও দেখে তাদের বিচার করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে মেট্রোরেলে আক্রমণ করার সাহস করতে না পারে।‘ মিরপুর-১১ নম্বর থেকে মতিঝিলে মেট্রোরেলে চড়ে অফিসে যেতেন বেসরকারি চাকরিজীবী ইলিয়াস আহমেদ। তিনি বলেন, মেট্রোরেল সুবিধার কারণে তিনি এত দূর থেকেও খুব সহজে অফিসে যাতায়াত করতে পারছিলেন এতদিন। ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘এতো দূরে অফিস। কিন্তু কোনো চিন্তা ছিল না, কারণ মেট্রোরেলে আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যেতাম। এখন মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ায় খুব বিপদে পড়ে গেছি। জ্যামে বসে থাকতে অস্থির লাগে, সময়ও নষ্ট হচ্ছে। চিন্তায় এখন বারবার ঘুম ভেঙে যায়। এখন যত সময় নিয়েই বের হই না কেন, সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারব কি না, সে চিন্তা থাকেই।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত