ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন রূপে জনতার কাতারে পুলিশ

নতুন রূপে জনতার কাতারে পুলিশ

গতকাল সোমবার রাতে রাজন দাশ নামের এক পুলিশ সদস্য তার সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন ‘পুলিশ হয়েছে সংস্কার’ ‘আমরা হয়েছি জনতার’ ‘চলো চলো কর্মে চলো’ ‘জনগণের সেবা করো’। শুধু রাজন দাশ নয়, রাত ১০টার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় মঙ্গলবার কর্মস্থলে ফেরার প্রত্যয় নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের নিজস্ব প্রোফাইল ‘লাল’ করে ‘পুলিশ হিসেবে স্বাধীন’ বলে স্ট্যাটাস দেন।

গত শুক্রবার থেকে সেনাবেষ্টিত থানার কার্যক্রম শুরু হলেও কক্সবাজারের ৯ থানা, পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে ঘোষিত কর্মবিরতির কারণে কর্মস্থলে ফিরেনি বেশিরভাগই পুলিশ সদস্য। ১১ দফা দাবি আদায়সহ নানা বিষয়ে ক্ষোভ থেকেই কর্মস্থলে ফিরছিল না তারা।

গত রোববার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যরা। ওই বৈঠকে পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগোয় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম, বিজিবির মহাপরিচালক, পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল সোমবার রাতে বিষয়টি পুলিশ বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সকালে থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়িতে পুলিশ সদস্যরা আসতে শুরু করে। দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশের আগত সদস্যদের ছাত্র -জনতা ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

গতকাল সকালে কক্সবাজার শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঘুরে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম চোখে না পড়লেও দুপুরে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম শুরু করেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি দুপুর ২টার দিকে শহরের গুণগানতলা এলাকায় উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের সাথে মনোবল ফেরাতে নানা দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন। সবকিছু ভুলে কর্মে মনযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। কক্সবাজার শহরের গুণগাছতলা এলাকায় দেখা হয় রামু কলেজের ছাত্র আলফুয়াদ রাফির সাথে। তিনি বলেন, গত ৮ দিন সড়কে যানজট নিরসনে কাজ করতে এসে বুঝতে পারলাম সড়কে ট্রাফিক পুলিশ কতো কষ্ট করে।

একইভাবে গতকাল সকালে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকালে তেমন পুলিশের উপস্থিতি না থাকলেও দুপুর নাগাদ পুলিশের উপস্থিতি বেড়েছে। থানায় চেয়ার, টেবিল না থাকায় থানার নিচের ফ্লোরে জড়ো হয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায়।

অন্য থানা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশি পুলিশ ভাই কর্মস্থলে ফিরেছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানা ও ঈদগাহ থানায় পুলিশি কার্যক্রম স্থবির থাকলেও অন্য থানাগুলোতে অনেকটা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

গতকাল দুপুরে কথা হয় কক্সবাজারের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে। তারা বলেন, ইতিহাসে পুলিশের জন্য ৫ আগস্ট একটি স্মরণীয় দিন। আজীবন মনে থাকবে সেই দিনের কিছু হিংস্রতা ও কিছু মানুষের ভালোবাসা। তারা বলেন, এরকম ঘটনা দরকারও ছিল। পুলিশ তাঁবেদারি খোলস থেকে বের হওয়ার জন্য। অনেকেই নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘নতুন পোশাকে’ আসতে পারলে ভালো লাগতো। আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক কনস্টেবল শোয়েবুর রহমানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান মাঠ পুলিশ।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কথা হয় কুতুবদিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কাইছার হামিদের সাথে। তিনি বলেন, অধিকাংশ পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে ফিরেছে। তবে গতকাল ৭টা পর্যন্ত কোনো মামলা, জিডি, অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে স্থানীয় ছাত্র-জনতা পুলিশের সাথে কুশল বিনিময় করতে আসছেন। পুলিশও পুরো দ্বীপ উপজেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে টহল জোরদার করেছে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

কথা হয় উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট থেকে ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় উখিয়ার পরিবেশ শান্ত রয়েছে। কর্মস্থলে ফিরেছে পুলিশ সদস্যরা। থানার কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। তিনি উখিয়ার ছাত্র-জনতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

সোমবার রাতে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, টেকনাফ থানায় পুরোদমে সব সেবা চালু হয়েছে। গতকাল সোমবার তিনটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এ ঘটনায় ৮ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।

কক্সবাজার আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মো. গোলাম জিলানী বলেন, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন থানা থেকে ২৫ জনকে আনা হয়েছে। তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, মাঠ পুলিশের মনোবল ফেরাতে তাদের ‘মোটিভেশন’ করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, গত ৫ আগস্টের ঘটনায় কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা সদরের অফিসে অগ্নিসংযোগ ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলার ১০টি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে এবং ভবনের ক্ষতিছাড়া বিভিন্ন সরঞ্জাম লুটপাটসহ ১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জেলার নয় থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে ফিরেছে। তিনি ছাত্র-জনতার সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রসঙ্গত, গত রোববার বৈঠক শেষে পুলিশের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারী পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও কনস্টেবল শোয়েবুর রহমান। তারা বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে যেসব দাবি জানিয়েছিলাম তার বেশিরভাগই মেনে নেয়ার আশ্বাসে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছি। আশা করি, সবাই সুন্দরভাবে নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরবেন।

পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। পুলিশের দাবিগুলো বেশিরভাগই মেনে নেয়া হয়েছে। দ্রুত পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পুলিশ নিয়ে স্বাধীন একটি কমিশন হওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

প্রাপ্ততথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় থানাসহ বিভিন্ন দপ্তরে ১ হাজার ৪১৪ জন পুলিশ সদস্য রয়েছে। এর মধ্য পুলিশ সুপার একজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পাঁচজন, সহকারী পুলিশ সুপার তিনজন, পুলিশ পরিদর্শক ৬১ জন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ১৬৫ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ১৪০ জন ও কনস্টেবল ১০৩৯ জন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত