চসিক মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সিলর আত্মগোপনে

প্রায় চার কোটির বেশি ক্ষয়ক্ষতি

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

দেশজুড়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দেশত্যাগের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে দেশের সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম। আকস্মিক সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অবশেষে অফিস করা শুরু করেছেন। সিটি করপোরেশনের ৪১টি সাধারণ ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর আছেন ৫৫ জন। এর মধ্যে অন্তত ১০ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বিভিন্ন নথিপত্র ও সনদে সইও করছেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অফিস করলেও সেবাগ্রহীতার সংখ্যা এখনো কম। তবে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এখনো প্রধান কার্যালয়ে আসছেন না।

মেয়র-কাউন্সিলরবিহীন চসিকের কার্যক্রম গত ছয়দিন ধরে অচল থাকার পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের পর কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, যাতে প্রায় চার কোটি ৩২ লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ড কার্যালয়ের সচিবদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নাগরিক সেবা দ্রুত চালুর চেষ্টা করছেন কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে মেয়রের বাড়ি, ২৭টি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের পাঁচটি কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আর কার্যালয়ে আসছেন না।

চসিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা ও চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত ৯ দিন ধরে নিজ কার্যালয়ে আসছেন না। এমনকি তিনি তার বাড়িতেও নেই। বন্ধ রয়েছে তার মোবাইল ফোন। মেয়র কোথায় অবস্থান করছেন কিংবা কবে নাগাদ অফিস শুরু করবেন তার কোনো তথ্য জানা নেই চসিক কর্মকর্তাদের। তারা নিয়মিত অফিস করলেও অনেক কাজ আটকে রয়েছে তার অনুপস্থিতিতে। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম চলছে বলে জানান কর্মকর্তারা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দুদিন আগে অর্থাৎ ৩ আগস্ট চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা হয়। এরপর ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানান মেয়রের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন।

মেয়রের অনুপস্থিতিতে কী ধরনের অসুবিধা তৈরি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মেয়র স্যার না এলে প্রকল্পের এস্টিমেট ফাইলে সই হবে না, টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে, কোনো ধরনের প্রকিউরমেন্ট করা যাবে না। তারচেয়ে বড় জরুরি কাজের ক্ষেত্রে মেয়রের অ্যাপ্রুভাল ছাড়া কোনো কাজ হবে না।

এদিকে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়গুলোও তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল গত ছয়দিন। তাদেরও কেউ কার্যালয়ে আসছেন না। ফলে জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয়তা সনদ, চারিত্রিক সনদ, উত্তরাধিকার সনদ, ওয়ারিশান সনদ নিয়ে ভোগান্তিতে আছেন সাধারণ নাগরিকরা। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, ৪১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ১৪ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলরের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মেয়রের অনুপস্থিতির কারণে চসিকের বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিয়মিত কর্মস্থলে উপস্থিত থাকছেন। শুরুর দিকে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। তিন দিনে প্রায় দশ হাজার টন বর্জ্য জমে যায়। গত ৮ আগস্ট চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করে কার্যক্রম সচল করেন। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অধীন হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা চালু আছে। নাগরিক সেবা আগের অবস্থায় ফেরাতে আমরা কাজ করছি।

এদিকে, চসিকের জনসংযোগ বিভাগ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। নয়টি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় অক্ষত আছে। পাঁচটি কার্যালয় থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৪টি সংরক্ষিত কাউন্সিলরের কার্যালয়ের মধ্যে পাঁচটি আক্রান্ত হয়েছে। নয়টি কার্যালয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ২০০ টাকা বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

চসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আজিজ আহমেদ জানান, ওয়ার্ড সচিবদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গত সোমবার থেকে ওয়ার্ড অফিসগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলররা অনেকটা আত্মগোপনে আছেন। আমাদের সঙ্গে ১৭-১৮ জনের যোগাযোগ হয়েছে। বলতে গেলে, উনারা ওপেন হয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যেকটি কাউন্সিলরের কার্যালয় সচল করে সেখান থেকে যাতে নাগরিক সেবাটা দেয়া যায়, সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যান। ওই দিন সিটি করপোরেশনের মেয়রের বাড়ি এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলদের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে যান। তাদের অনুপস্থিতি সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে সেবা নিতে আসা লোকজনের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে। শীঘ্রই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে এমনটি আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।