অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। তা আর হলো না। এই পৃথিবীতে থেকে লাভ কি। কাকে নিয়ে থাকব। আল্লাহ আমাকে এত বড় আঘাত দিলো কেন যা আমি সহতে পারছি না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন কোটা আন্দোলনে নিহত ইয়াছিনের মাতা মনজিলা বেগম। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় রাজধানীতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন খুলনার ইয়াছিন (১৭)। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারের সবাই এখন দিশাহারা।
ঘটনার প্রায় ৪ মাস পার হলেও ইয়াছিনের পরিবারের কান্না ও আহাজারি এখনো থামছে না। খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের রহিমনগর গ্রামে তার ভাড়া বাড়িতে এমন দৃশ্য দেখা যায়। গত ২১ জুলাই কোটা বিরোধীদের সংঘর্ষে রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকায় কাজ শেষ করে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয় ইয়াছিন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৫ জুলাই মারা যায় ইয়াছিন। পরদিন ২৬ জুলাই বুকের ভেতর গুলি রেখেই ময়নাতদন্ত করে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে তার গ্রামের বাড়ি কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত ইয়াছিন খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের রহিমনগর গ্রামের মৃত নুর ইসলাম শেখের ছেলে। মাতা মনজিলা বেগমের সাথে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বসবাস করতেন ইয়াছিন। ঢাকার একটি গ্যাসের দোকানের কর্মচারী ছিল। ছোট একটা কাজ করে মাকে নিয়ে সংসারের খরচ মেটাতেন। এদিকে ইয়াছিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
মৃত্যুর একমাস পার হয়ে গেলেও তার খোঁজখবর নেয়ার জন্য এখনো কেউ তার পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি। ছোট বেলায় পিতাকে হারিয়ে অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। দোকানের কর্মচারীর কাজ করে যে টাকা পেতেন তাতে তাদের সংসার চলত না।
যে কারণে তার মা কাগজ কারখানায় কাজ করতেন। নিহত ইয়াছিনের মা মনজিলা বেগম বলেন, পিতা হারা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে থাকতাম। গ্যাসের দোকানে হোম ডেলিভারীর কাজ করত। ২১ জুলাই কয়েকজন জানায় ইয়াছিনের গায়ে গুলি লাগে।
আমি ছুটে গিয়ে দেখতে পাই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। ধার করে টাকা দিয়ে ওকে চিকিৎসা করায়। চিকিৎসা করিয়ে ওকে বাঁচাতে পারলাম না। কোথা থেকে গুলি এসে বাবার বুকটা ঝাঁঝড়া করে দিল।
আমি কাকে নিয়ে বাঁচব। তিনি বলেন, মামলা করে কি হবে। আমার সন্তানকে তো আর ফিরে পাব না। আমরা গরিব মানুষ। আমার বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না। সে কোনো কোটা আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে ছিল না। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? এখন কীভাবে চলবে আমাদের সংসারের খরচ। সঞ্চয় বলতে কিছুই নাই। কার কাছে বিচার চাইব।
নিহতের বোন নুরজাহান আরো বলেন, আমার ভাইয়ের বুকে তিনটা গুলি লাগে। তার মধ্যে দুইটা বের হয়ে গেলেও একটা বুকে থেকে যায়। ‘ভাই মারা যাওয়ার কারণে চিকিৎকরা মরদেহের ভেতর থেকে আর গুলি বের করেননি।
এ অবস্থায়ই গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তাকে দাফন করা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুতে তার সংসারটি অসহায় হয়ে গেল। সরকারি কোনো সহায়তা না পেলে এ পরিবারকে রাস্তায় বসতে হবে। জামায়াত ইসলাম কয়েকদিন আগে দুই লাখ টাকার একটা চেক দিয়েছে। আর কেউ খবরও নেয়নি। ভাইয়ের শোকে আমার মা দুনিয়া থেকে কখন হারিয়ে যাবে জানি না।