রংপুর অঞ্চলে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রংপুর ব্যুরো
শস্যভাণ্ডার বলে পরিচিত রংপুর অঞ্চল। চলতি মৌসুমে কৃষি প্রণোদনায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার রংপুর বিভাগে ৫ জেলায় চাহিদা মিটিয়ে বেশি আমন ধানের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করছেন জেলার কৃষি বিশেষজ্ঞরা। উদ্বৃত্ত চাল অন্য জেলার চালের চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হবে। কৃষক আমনের দাম ও পাচ্ছে সন্তোষজনক। রংপুর অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের রংপুর, লালমনিরহাট, লীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামের ৫ জেলায় ৬ লাখ ২৭৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধরণ করা হয়েছে ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৬৭২ মেট্রিক টন। উপসী জাতের আমন ধানে ৭৮ হাজার ৮০০ কৃষককে কৃষি প্রণোদনা দেয়া ও হয়েছে। অন্যদিকে মাঠ ঘুরে কৃষক ও বর্গা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সার ও কীটনাশক ও সেচসহ বিঘা প্রতি অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে। ফলে তারা খুব একটা লাভবান হতে পারবেন না। অন্যদিকে, খাদ্য বিভাগ কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে চাল কেনার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য এবারও পাবেন না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। অথচ কম মূল্যে ধান কিনে ব্যবসায়ীরা চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা নেবেন এবারও।
কৃষকদের অভিযোগ, তারা ধান বিক্রি করতে গেলে খাদ্য কর্মকর্তারা নানান অজুহাত দেখিয়ে অনীহা প্রকাশ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিবারই খাদ্য বিভাগ ধান চাল সংগ্রহ অভিযানের নামে গল্প বানায়; কিন্তু প্রকৃত কৃষক আর বর্গাচাষিদের কাছ থেকে ধান কেনে না। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলায় চলতি আমন মৌসুমে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৩ হেক্টর জমি। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে ধান চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন।
কৃষি বিভাগ আরো জানিয়েছে, এবার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল, বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। ফলে কৃষকদের জমিতে এবার খুব বেশি সেচ দিতে হয়নি। ফলে যথাসময়ে জমিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে চারা রোপণ এবং অপেক্ষাকৃত কম সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। রংপুর জেলার মানুষের চালের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন। সেখানে চাল উৎপাদন হচেছ প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি।
ফলে জেলার এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য রংপুর জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। সরেজমিন রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর, পালিচড়া, পাগলাপীর, নজিরহাট, মিঠাপুকুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বু: হরিপুর, শিব দেইলপাড়া, দেউলপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠে সোনালি ধানে ভরে ছিল। পালিচড়া গ্রামের বর্গাচাষি সালাম, মঞ্জুর হোসেনসহ অনেকেই জানালেন, এবার ইউরিয়া সার পাওয়া গেলেও ডিএপিসহ অন্য সারের দাম অনেক বেশি ছিল। সেই সঙ্গে জমি তৈরি ও চারা রোপণের সময় জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষেতমজুরদের মজুরি এখন ৫০০-৬০০ টাকা দিতে হয়- তার ওপর দুপুরে এক বেলা ভাত খাওয়াতে হয়- ফলে ধান উৎপাদনে খরচ এখন অনেক বেশি লাগে।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর এলাকার প্রাস্তিক কৃষক সোলায়মান আলী, আফছারুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, খাদ্য বিভাগ চাল কেনার দাম নির্ধারণ করেছে ৪২ টাকা কেজি। আর ধান কিনবে ৩০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে মিল ও চাতালসহ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনেন। ফলে ওই সব ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ধান কেনেন নামমাত্র মূল্যে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এর ফলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তারা। আর খাদ্য গুদামে ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিরা ধান নিয়ে গেলে কিনতে চান না। তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে আসতে বলেন।
তারা জানান, কিন্তু উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তালিকা করার সময় বর্গাচাষিদের নাম তালিকাভুক্ত করে না। তারা জমির মালিককে খোঁজেন। কিন্তু বাস্তবতা হচেছ, জমির মালিক নয়, ক্ষুদ্র ও প্রাকি কৃষক আর বর্গাচাষিরাই মূলত ধান চাষ করেন। ফলে তাদের নাম তালিকাতেই আসে না- যার কারণে তারা ন্যায্য মূল্য কখনও পান না। এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন, এবার অন্য জেলার চেয়ে রংপুরে আমন ধানের ফলন অসম্ভব ভালো হয়েছে।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন চাল অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে। তিনি আরও বলেন, ধান কেটে ঘরে তুলছেন কৃষক। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পরপরই কৃষকরা জমিতে আলুর চারা রোপণ করবেন। অনেকে বোরো ধানের চারা রোপণ করার জন্য জমি তৈরি করবেন। ফলে খাদ্য রংপুরে সংকট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বিনা রংপুর কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডক্টর মোহাম্মদ আলী জানান রংপুর বিভাগের রংপুর, লালমনিরহাট, লীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরের ৮ জেলা জিংক সমৃদ্ধ ধান ব্যাপক চাষ করা হয়েছে। এই ধান শরীরে জিংক চাহিদা মিঠিয়ে থাকে।
চলতি আমন মৌসুমে বিনা ২০, বিনা ১৭, বিনা ১১ চাতের ধান কৃষককে প্রণোদনা ও দেয়া হয়েছে । ১২টন বীজ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তায় বিনা মূল্যে বিতবণ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন কৃষককে কৃষি উপকরণ দেয়া পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও দেয়া হয়েছে। তাই চলতি মৌসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।