ঢাকা ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রংপুরে চালের দামে নাভিশ্বাস

রংপুরে চালের দামে নাভিশ্বাস

রংপুর অঞ্চলে রোপা আমন ধান কাটা ও মাড়াই প্রায় শেষ। তবে উঠানে ধান থাকলেও স্বস্তিতে নেই কৃষক। হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। শস্যভান্ডার বলে পরিচিত এ অঞ্চলেই ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম। মান ও প্রকারভেদে দাম বেড়েছে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। খুচরায় কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলে আবাদযোগ্য জমি প্রায় ১৩ লাখ হেক্টর। বিভাগের জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এ অঞ্চলে চাহিদা ২৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। ফসল উৎপাদন হয়েছে ৫৫ লাখ টনের ওপরে। এই অঞ্চলে উৎপাদিত ধানের উল্লেখযোগ্য অংশ দক্ষিণাঞ্চলে চলে যায়। সেখান থেকে চাল হয়ে আবার রংপুরেই ফিরে আসে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ধান ওঠার মৌসুমে একটি সিন্ডিকেট মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে কমদামে তা কিনে মজুতের পাহাড় গড়ে মুনাফা লুটছে। মজুতবিরোধী অভিযানের ঘোষণা থাকলেও তা কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। উদ্বৃত্ত ধানের এলাকা রংপুর অঞ্চলে চাল আসে দক্ষিণাঞ্চল থেকে। রংপুর বিভাগের মানুষকে চাল কিনে খেতে হচ্ছে কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণের অন্য জেলাগুলো থেকে। কারণ অটোরাইস মিলের ৮০ শতাংশই ওইসব অঞ্চলে। চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগে প্রায় ৫৫ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। তার পরও মৌসুমের শুরুতেই বৃদ্ধি পেয়েছে চালের দাম, যদিও বর্তমানে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে প্রতি মণ ধান প্রকারভেদে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকের উঠানে ধানের আঁটি (খড়) পড়ে থাকলেও নেই আগের মতো ধান সেদ্ধ ও শুকানোর ব্যবস্থা, সংরক্ষণের জন্য গোলায় নেই ধানের স্তুপ। কৃষকরা জানান, সংসারের খরচসহ ধান উৎপাদনে নেয়া ঋণ পরিশোধ ও পরে ফসল চাষের জোগান দিতে ধান কেটেই বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। সারা বছরের জন্য ধান সংরক্ষণের কোনো সুযোগ থাকে না। আগেই ধান বিক্রিতে ভালো দাম মেলে না। এছাড়া বেশি দামে চাল কিনে খেতে হয়। তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি গ্রামের কৃষক নজর আলী বলেন, ধানের আবাদ করলেও গ্রামের ছোট-বড় সব কৃষকই এখন চাল কিনে খান। প্রয়োজনের তাগিদে কাটার পরই ধান বিক্রি করতে হয়। ঘরে তোলা ধান সেদ্ধ করা ও শুকাতে শ্রমিক ও জ্বালানির খরচ বেশি। এছাড়া মিলে ধান ভেঙে চাল করতে খরচ বেশি হওয়ায় ঝক্কি নিতে চান না কেউ।

গতকাল শুক্রবার সিটি বাজার, সিও বাজার, ধাপ বাজারসহ রংপুরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বর্ণা ও ব্রিধান-২৯ জাতের মোটা চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। দু’দিন আগেও এর দাম ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। আর মাঝারি মানের চালের (ব্রি-২৮) দাম ৬২ টাকা ছিল। এখন ৬৫ টাকা। এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভালো মানের চিকন চাল (নাজিরশাইল, জিরাশাইল ও মিনিকেট)। চিকন চাল প্রতি কেজি ৬৮ টাকার মতো ছিল। দাম বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ৭৫ টাকা। সাধারণ মানুষের ভরসা নিম্নমানের মোটা চালও এখন ৬০ টাকা কেজির নিচে কোনো বাজারেই মিলছে না। রংপুর সিটি বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক বাহারুল ইসলাম জানান, বাবা-মা সন্তানসহ সাতজনের সংসারে প্রতিদিন গড়ে তিন কেজি চাল প্রয়োজন হয়। এ জন্য ১৮০ টাকা জোগাড় করতে খুবই কষ্ট হয় তার।

ধানের মৌসুমেই সপ্তাহে দু-একবেলা না খেয়েই কাটাতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, চালের বাজার ফের অস্থির হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষ চাপে রয়েছেন।

শ্রমজীবী অহেদ আলী বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়েনি অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মোটা চালের কেজি ৬০ টাকায় উঠেছে। কম খেয়েও আমাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের চলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’ খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাইসমিল মালিক ও মজুতদারদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণের কারণে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রতিও অভিযোগ রয়েছে তাদের।

সিটি বাজারের চালের দোকানদার আশেক আলী বলেন, আমরা বেশি দামে কিনি বলেই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। তবে স্থানীয় মিল মালিক ও আড়তদাররা বলছেন, কৃষকরা ধান চাষ করলেও তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে। তাদের বড় মোকামে সব ধরনের চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রংপুরের বাজারেও। চালের মোকাম হিসেবে পরিচিত রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকার আড়তদার মাসুম আলী জানান, ক’দিন আগেও মাঝারি চিকন চালের বস্তা (৫০ কেজি) ছিল তিন হাজার টাকা। বর্তমান বাজার মূল্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ব্রিধান-২৮ জাতের চালের বস্তা ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা, বর্তমান বাজারমূল্য ৩ হাজার ২০০ টাকা। মোটা চালের (স্বর্ণা ও ব্রিধান-২৯) বস্তা ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি জানান, দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও উত্তরের প্রায় ৬০০ অটোরাইস মিল মালিক নিজেদের ইচ্ছামতো মজুতের পাহাড় গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। যোগাযোগ করা হলে রংপুর জেলা রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বিষয়টি স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, নানা সংকটে কৃষকদের ধান কেটেই বিক্রি করতে হয়। আর এই সুযোগটি নেন বড় মিল মালিকরা। মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ধান কিনে তারা মজুত করেন।

তবে সুযোগ গ্রহণে দক্ষিণাঞ্চলের বড় ব্যবসায়ীদের নিয়োগ করা লোকজন এই অঞ্চলের কৃষকদের ধান কিনে নেন। মজুতের বড় অংশ তাদের কাছে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, হঠাৎ করে বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে জোর মনিটরিং করা হচ্ছে।

কৃষিবিদরা জানান, দেশের কৃষিভিক্তিক অর্থনীতিতে রংপুর অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ফসল ওঠার শুরুতেই একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে নেমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে সুফল মিলছে না। প্রতিটি ধানের মৌসুমে দক্ষিণের অটোরাইস মিল মালিকরা রংপুর থেকে ধান কিনে মজুতের পাহাড় গড়ে তোলে। এরা মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

ফলে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা শুধু ধান-চালই উৎপাদন করছেন না, চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ শাকসবজি চাষ হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগীসহ নানা কারণে তারা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এলাকায় উদ্বৃত্ত ফসলের সুফলও পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত