রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীতে বেড়েছে ছিনতাই। সেই সাথে ছিনতাইকারীদের হাতে গুরুতর আহত হওয়ার পাশপাশি ঘটছে প্রাণহানিও। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, শাহ আলী, এমনকি গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। মূলত সন্ধ্যার পরে ছিনতাই বেড়ে যায়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ সদস্যরা থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় অপরাধ দমন কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছিল। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। পুলিশের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার পদে পরিবর্তন আনা হয়। তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। এর ফলে দিনে-দুপুরে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস থেকে রাজধানীতে ছিনতাইকারীরা আরো যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বস্ব কেড়ে নিতে মারমুখী হয়ে উঠছে পেশাদার ছিনতাইকারীরা। গত পাঁচ মাসে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ গেছে ৭ জনের। গত চার মাসে ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিনতাই রোধে নানা পদক্ষেপের কথা বলছে। তবে এখনো দৃশ্যমানভাবে কমেনি ছিনতাই। পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশের দেয়া তথ্য শুধু মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। যার বেশিরভাগই থানায় নথিভুক্ত হচ্ছে না। অধিকাংশ ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করছেন না, কেউ কেউ হারানো বলে জিডি করছেন। যখন শারীরিকভাবে জখম, মারধর কিংবা নিহতের মতো ঘটনা ঘটছে, কেবল সেসব ক্ষেত্রে মামলা বা অভিযোগ জমা পড়ছে থানায়। গত ১৮ নভেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছিনতাইয়ের শিকার হন রবিউল মিল্টন নামে এক যুবক। তিনি বলেন, অজ্ঞাতনামা ৫ জনের একটি দল আদাবর এলাকা থেকে আমার ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এ সময় চাপাতির চ্যাপ্টা পাশ দিয়ে আমার মাথায় দুটি, চাপাতির উল্টো পাশ দিয়ে বাম পায়ের পেছনের হাঁটুর উপরে এবং ডান হাতের কব্জিতে আঘাত করে। এলাকার ৯ নম্বর এবং ১০ নম্বর গলির মাঝামাঝি থেকে ছিনতাইয়ের শিকার হই। ছিনতাইকারীরা পরে ৮ নম্বর গলি থেকে আরো একজনের মোবাইল ফোন ছিনতাই করার পর কয়েকজন তাদের ধাওয়া দিলে একজনের মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপ মেরে পালিয়ে যায়। তবে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার ল্যাপটপের ব্যাগটি ফেলে রেখে যায়। ৭ নম্বর রাস্তার একটি বাড়ির কেয়ারটেকার আমার ব্যাগটি বাড়ির সামনে থেকে পেয়ে সংরক্ষণ করেন। পুলিশ আসার পর আমার ল্যাপটপ বুঝিয়ে দিয়ে থানায় নিয়ে যায় জিডি করানোর জন্য। ই রাতে হাফেজ কামরুল হাসান তার বন্ধুদের সঙ্গে সাজেক যাওয়ার জন্য রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা করেন। রাত পৌনে ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ এলাকায় নেমে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি ফ্লাইওভারের ওপর সাথী আবাসিক হোটেল বরাবর পৌঁছালে কয়েকজন ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে। ছিনতাইকারীরা দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার কাছে থাকা নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চায়। বাধা দিলে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছিনতাইকারী ধারালো চাকু দিয়ে কামরুলের বুকে আঘাত করে।
এরপর তিনি ফ্লাইওভারের ওপর লুটিয়ে পড়লে ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় কামরুল হাসানকে ফ্লাইওভারের ওপর পড়ে থাকতে দেখে পথচারীরা ধলপুরের ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে মারা যান কামরুল। ঘটনায় তার বাবা ইমাম হোসেনের যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বয়স ১৬ ও ১৭ বছর। পুলিশ জানিয়েছে, দুজনই মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই করেছিল তারা। ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর আসাদ গেট এলাকায় যানজটের মধ্যে সড়কে চাপাতি হাতে ঘুরছিল তিন যুবক। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারের জানালা দিয়ে থাবা দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তারা। পুলিশ সূত্রে জানায়, রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন। তবে সুনির্দিষ্ট করে ছিনতাইজনিত কোনো জিডির তথ্য নেই পুলিশের কাছে। যদিও এই ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সংখ্যাই বেশি। ৫ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, গত বছরের (২০২৪ সালের) আগস্ট মাসে পুলিশি কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এখনো পুলিশি কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশকে আরো সক্রিয় ও বিট পুলিশিংকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে।
রাজধানীতে ছিনতাই মামলা : গত বছরের শেষ চার মাসে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১২৫টি আর ডাকাতির ঘটনায় দায়ের করা মামলা ২২টি। গত সেপ্টেম্বরে ছিনতাই মামলা ১৭টি, ডাকাতির ৫টি। অক্টোবরে ছিনতাই মামলা ৩৩টি, ডাকাতির মামলা ৬টি। নভেম্বরে ছিনতাই মামলা ৩৮টি, ডাকাতির ২টি এবং ডিসেম্বরে ছিনতাই মামলা ৩৭টি, ডাকাতির ঘটনায় দায়ের মামলা ৯টি। সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়।
৬ বছরে পুলিশের পরিসংখ্যানে ছিনতাই : ২০২৪ সালে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৮৫৯টি, ২০২৩ সালে যা ছিল ১২২৭টি। যদিও ২০২৪ সালে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ছিল। এর আগে ২০২২ সালে ১১২৮টি, ২০২১ সালে ৯৭১টি, ২০২০ সালে ৯৭৮টি, ২০১৯ সালে ৮৯৬টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ছিনতাইয়ের অভিযোগ ও থানায় করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ৯১, নভেম্বরে ১৪৮ ও সর্বশেষ ডিসেম্বরে রেকর্ড ৫৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিএমপির এই পরিসংখ্যানই বলছে পুলিশ কতটা তৎপর হয়েছে। সার্বক্ষণিক ডিউটিতে থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। ঝুঁকিপূর্ণ, জনবহুল ও ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় ডিবিপুলিশ কাজ করছে। আবাসিক এলাকার অলিগলিতে টহলে থাকছে থানাপুলিশ। র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, অপরাধ রোধে প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা, বিশেষ করে রাতে টহল কার্যক্রম ও চেকপোস্ট জোরদার করতে বলা হয়েছে।