দীর্ঘ ৫৭ বছর পর কাঙ্ক্ষিত প্লান্টের কাজ শুরু হলেও মেডিকেল মোড় এলাকাবাসীর বিরোধীতার ফলে বন্ধ হয়ে গেল সব কার্যক্রম। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের দূষণরোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন এখনো অধরাই রয়ে গেল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত পাঁচ বছর ধরে একটি এনজিওর মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে বর্জ্য সরালেও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় হাসপাতাল চত্বরে এখনো পড়ে থাকছে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মেডিকেল বর্জ্য। বাধ্য হয়ে মানুষজন প্রতিদিন দুর্গন্ধ সহ্য করে হাসপাতালে আসা যাওয়া করছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (এইচইডি) রংপুর বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, টেন্ডারের মাধ্যমে ঝিনাইদহের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুনগুন এন্টারপ্রাইজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নির্মাণের কাজ পান। ৩ কোটি ৪২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয়ে এক বছর মেয়াদের প্লান্ট নির্মাণের কার্যাদেশ পান গত বছরের ৮ মে। প্লান্টটি ৫ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিটের একতলা বিশিষ্ট ভবন। এতে থাকবে অফিস রুম, অটোক্লেব এন্ড ইটিপি রুম, স্টোর রুম এবং কন্টেইনার ওয়াশরুম।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার সাকিব আহমেদ বলেন, কাজ বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত তারা জায়গাটিতে আগে থেকে রাখা বর্জের স্তূপ অপসারণ করে ভবনের জন্য মাটিক্ষণন পর্যন্ত করেছিলেন। এছাড়াও ভবনের জন্য প্রয়োজনীয় রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য উপকরণ আনাসহ সেখানে তাদের লেবারদের থাকার শেড পর্যন্ত তারা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পরে মেডিকেল মোড় এলাকাবাসীর বাধার মুখে কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্টের নির্মাণ কাজ বন্ধের জন্য গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেয়।
মেডিকেল মোড় এলাবাসির পক্ষে ডা. মো. গোলজার হোসেন এবং ডা. মো. জিকুল হকসহ আরো বেশ কয়েকজন অভিযোগ পত্রে স্বাক্ষর করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, আমরা রংপুর মেডিকেল মোড় এর স্থায়ী বাসিন্দা। রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দক্ষিণ গেইট সংলগ্ন বিএমএ ভবনের পাশে মেডিকেলের বর্জ রিসাইকেলিং প্লান্টের ভবণটির নির্মাণ কাজের প্রস্তুতি চলছে। নির্মানাধীন প্লান্টির আশে পাশে আবাসিক এলাকায় অনেক সাধারণ মানুষ বসবাস করেন। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেরসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক, হাসপাতাল, কনসাল্টেশন সেন্টার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এমনভাবস্থায় প্লান্টটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় নির্মাণ হলে বসবাসরত সাধারণ মানুষ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গুলো নানা রকম পরিবেশ জনিত সমস্যা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নানা রকম পরিবেশ দূষণ সমস্যার সম্মুখীন হবে। তাই জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করার পাশাপাশি উপরে উল্লেখিত সমস্যা জনিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বর্জ সংরক্ষণ ও রিসাইকেলিং প্লান্ট এর ভবণটি আবাসিক এলাকার বাহিরে স্থাপন করার পাশাপাশি এই স্থানে নির্মাণ স্থগিত করে এলাকাবাসীর শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে আর্জি জানানো হয়। এ সব অভিযোগের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ভবন নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থানগত সার্টিফিকেট না নেয়াকে ঘুরেফিরে সামনে আনে অভিযোগকারিরা।
বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের সব মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধানতম ও একমাত্র ভরসাস্থল রমেক হাসপাতাল। এই হাসপাতাল টি ১৯৬৮ সালে ৬৫ একর জমির উপর ২৫০টি শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে ২৫০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭৬ সালে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়, ১৯৯৩ সালে ১০০ শয্যা বর্ধিত করে ৬০০ শয্যায় রুপান্তরীত এবং ২০১০ সালে সর্বশেষ ১০০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। প্রশাসনিক অনুমোদন প্রাপ্ত ১০০০ শয্যার হাসপাতালে বর্তমানে ১৮০০-২২০০ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে। প্রতিদিন বহিঃবিভাগে ১২০০-১৪০০ জন রোগী এবং জরুরি বিভাগে ৪০০-৫০০ জন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে আধুনিক সিসিইউসহ মোট ৪২ টি ওয়ার্ড, ১২টি ওটি, ১০ শয্যার আইসিইউ, ২৫ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট, ০৬ শয্যার ডে-কেয়ার ইউনিট, ভায়া সেন্টার, ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেন্টারে রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু রহিয়াছে। ফলে প্রতিদিন মেডিকেল বর্জ্যসহ নানা ধরনের বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে ২০২০ সাল থেকে প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (পিবিএফ) এনজিও মেডিকেল হাসপাতালে বর্জ্য টাকার বিনিময় নিয়মিত সংগ্রহ করে থাকেন। তবে পিবিএফ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন যে, রমেক হাসপাতালে সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্য মিশ্রণ হচ্ছে সব সময়। যা সহজে আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এর উত্তর জোনের সমন্বয়ক মো. ইসতাক মাহফুজ বলেন, প্রতিদিন রমেক হাসপাতালে মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় এক থেকে দেড় টন। এর মধ্যে মেডিকেল বর্জ্যরে ৩০০ কেজির মতো। অধিকাংশই সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে।
রমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন নির্মাণাধীন প্লানটি এবং হাসপাতাল চত্বরের বাহিরে বসবাসকারীরা লিখিত অভিযোগ দেয়ার পাশাপাশি তারা চলমান কাজ বন্ধের জন্য বিক্ষোভ করেছে। তাদেরকে অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এমনকি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তিনিও ছিলেন। তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। এমনকি কাজ বন্ধ না হলে তারা মামলা পর্যন্ত করবে বলে জানিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই স্থানে প্লান্ট নির্মাণের কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছি।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, আশেপাশের মানুষের বাধার জন্য প্লান্টটি নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তিনি নিজেও চেষ্টা করেছেন। কোন সমাধান না হওয়ায় বিকল্প জায়গায় প্লান্টটি নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান্টের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ডা. এবিএম মশিউর রহমান বলেন, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নির্মাণের কাজ চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে প্লান্ট নির্মাণের সময় আশেপাশের কিছু মানুষ পরিবেশ দূষণ হওয়ার অজুহাতে প্লান্টের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজ চলমান রাখলে মামলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। তাদেরকে কোনোভাবে বুঝানো সম্ভব হয়নি। তাই প্লান্ট নির্মাণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মীর সারোয়ার হোসাইন চৌধুরী বলেন, একই ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট ঢাকায় বান ইনস্টিটিউটের ভবনের বেইজমেন্টে আছে যদি এটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতো তাহলে এ ধরনের প্লান্ট কখনো হাসপাতালের ভবনে হতো না। কিন্তু রমেক হাসপাতালে যাদের জন্য এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তারাই সামাজিকভাবে বাধার সৃষ্টি করেছে। আমি নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে প্লান্টটির কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত করেছি কিন্তু তারা কিছুতেই বুঝতে চাইনি। এমনকি মামলার হুমকি দিয়েছে। তাই আমরা তো কারো সঙ্গে ঝগড়া করে এ ধরনের প্লান্ট করতে পারি না। যদি তারা বোঝে তাহলে আমরা অবশ্যই প্লান্ট স্থাপন করবো।