পবিত্র ঈদুল ফিতর দরজায় কড়া নাড়া শুরু হওয়ায় টুপি কারিগররা টুপি তৈরিতে ব্যস্ত। তারা রঙিন সুতা এবং নান্দনিক নকশার সংমিশ্রণে টুপি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলার টুপি করিগররা নান্দনিক নকশা দিয়ে দক্ষতার ছোঁয়ায় শতশত নারী অর্থ উর্পাজন করছে। এই নান্দনিক টুপি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব উপলক্ষে রমজানের শুরু থেকেই জেলার হাজার হাজার টুপি কারিগর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের টুপি তৈরির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ ঠাকুরদাস এলাকার রাজেনা বেগম, মারুফা খাতুন, ফাতেমা, রেজওয়ানা, মুক্তামনি, জেমি বেগমসহ কিছু মহিলা টুপি কারিগর জানান, ঈদ-উল-ফিতরের কারণে তাদের কোনো অবকাশ নেই কারণ তারা বর্তমানে টুপি সেলাইয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা জানান, প্রতিটি টুপি রঙিন সুতা এবং নকশার সংমিশ্রণে তৈরি করা হচ্ছে। শিল্পীর মনের পূর্ণ মাধুর্যের সঙ্গে কারিগরের দক্ষতার ছোঁয়ায় টুপিগুলো তৈরি করা হয়। প্রতিটি টুপি নান্দনিক নকশা দিয়ে তৈরি করা হয়, তারা আরও বলেন। তারা বলেন, প্রতি বছর ঈদের আগে টুপির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তারাও এই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। দেশের বিভিন্ন জেলার টুপি ব্যবসায়ীদের এজেন্টরা প্রতিটি টুপির জন্য অর্থ প্রদান করে তাদের কাছ থেকে টুপি সংগ্রহ করেন। ব্যবসায়ীদের এজেন্টরা তাদের টুপি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন কাপড়, নকশা এবং সুতাও সরবরাহ করেন। একজন কারিগর টুপি তৈরি করে মাসিক ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ টাকা আয় করতে পারেন। কিন্তু ঈদের সময় তাদের আয় ৪,০০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, তারা আরও বলেন। মান এবং নকশার উপর নির্ভর করে প্রতিটি টুপি তৈরি করে তারা ৮০০ থেকে ১৮০০ টাকা পান। এই পরিমাণ অর্থের সঙ্গে তারা তাদের স্বামীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে তাদের পারিবারিক আয়ে উল্লেখ যোগ্য অবদান রাখতে পারেন, তারা আরও বলেন। পীরগাছা উপজেলার নবদিগঞ্জ এলাকার গৃহিণী সাবিনা বেগম বলেন, ‘আমি মূলত টুপি ডিজাইন করি যা ওমানে রপ্তানি করা হয়। টুপি ব্যবসায়ীরা সেলাই শেষ করার পর আমার কাছ থেকে টুপি সংগ্রহ করে। ব্যবসায়ীরা টুপি কারিগরদের টুপির কাপড় এবং সুতোও সরবরাহ করে। আমার গড়ে মাসিক আয় ৩০০০ টাকা। তবে ঈদের সময় আমি ৪৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা আয় করতে পারি। পারিবারিক খরচের জন্য আমি প্রতি মাসে আমার স্বামীকে কিছু টাকাও দিই।’ ‘আসন্ন ঈদ উপলক্ষে টুপি সেলাই থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে আমি আমার মেয়ের জন্য একটি নতুন পোশাক কিনেছি’, তিনি আরও বলেন। সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ এলাকার আরেক টুপি শ্রমিক ফিরোজা বেগম বলেন যে, তিনি তিন বছর আগেও তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তার স্বামী একজন দিনমজুর ছিলেন। তার স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার পরিচালনা করা তার পক্ষে খুবই কঠিন ছিল, ফিরোজা বলেন।
হতাশ ফিরোজা ভাবতে শুরু করেন কিভাবে তাদের দরিদ্র পরিবারকে বাঁচানো যায়। পরে, তার এলাকার আরও কিছু মহিলা তাকে টুপি সেলাইয়ের কাজ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন। এভাবে তিনি তার পরিবারের আয়ে অবদান রাখার উপায় খুঁজে পান। তিনি আরও বলেন যে তিনি মাসে তিনটি টুপি ডিজাইন করেন। তিনটি টুপি ডিজাইন করে তিনি সাধারণত প্রতি মাসে ৩০০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু ঈদের সময় তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি মজুরি পান কারণ এই সময়ে টুপির চাহিদা বেশি থাকে। অতিরিক্ত আয়ের মাধ্যমে তিনি তার স্বামী এবং কন্যাদের সঙ্গে আরামে দিন কাটাতে পারেন এবং তার মেয়েদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। ঈদ উপলক্ষে তিনি আরও বলেন।
কাউনিয়া উপজেলার টুপি ব্যবসায়ী মুকুল মিয়া ও মাহমুদুল বলেন, বর্তমানে উপজেলার পাশাপাশি জেলার অন্যান্য এলাকার টুপি শ্রমিকরা ঈদকে সামনে রেখে টুপি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্থানীয় চাহিদা ছাড়াও, ওমান, কুয়েত এবং কাতারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও উপজেলায় তৈরি টুপির চাহিদা বেশি। নান্দনিক টুপি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়, তারা আরও জানান।
কাউনিয়া উপজেলার প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নজরুল মিয়া বলেন, কাউনিয়া এবং জেলার অন্যান্য কয়েকটি উপজেলার বেশ কিছু এলাকার দরিদ্র অতি দরিদ্র মহিলা গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি টুপি তৈরি থেকে আয় করে আর্থিকভাবে অবদান রাখার উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, টুপি তৈরি তাদের চরম দারিদ্র্যের অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।