ঢাকা মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

খেলাধুলার শরয়ি বিধান

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান
খেলাধুলার শরয়ি বিধান

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি মানবজীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গেই ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনেও বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। তাই শরীরচর্চা এবং আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের জন্য ইসলাম শর্ত সাপেক্ষে খেলাধুলার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি কিছু খেলাধুলার প্রতি হাদিসে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি সাওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছ।

হাদিসে যেসব খেলার কথা বর্ণিত হয়েছে

ইসলাম শর্ত সাপেক্ষে খেলাধুলা সমর্থন করে বটে; কিন্তু খেলাধুলার মাধ্যমেও ইসলামের মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে। কেননা শরীরচর্চার মাধ্যমে ইসলামের জন্য জীবন বাজি রেখে জিহাদের প্রশিক্ষণের কাজ হয়। দেহে প্রফুল্লতার সঞ্চার হয় এবং প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা, রণনৈপুণ্যের প্রয়োজনে তির নিক্ষেপ, বর্শা চালনা, দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদিকে ইসলাম সমর্থন করে। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে- প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘ঘোড়া অথবা তির নিক্ষেপ কিংবা উটের প্রতিযোগিতা ব্যতীত (ইসলামে) অন্য প্রতিযোগিতা নেই।’ (তিরমিজি : ৫৬৪)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তির চালনা শেখার পর তা ছেড়ে দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : ৭৬৬৮)।

অন্য এক হাদিসে এসেছে, উকবা ইবন আমির (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিন প্রকারের বিনোদন ছাড়া অন্য কোনো প্রকার বিনোদন অনুমদিত নয়।

এক. পুরুষের জন্য তার ঘোড়াকে কৌশলের প্রশিক্ষণ দান।

দুই. স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গে আমোদণ্ডপ্রমোদ করা।

তিন. তির-ধনুক পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়া, যে তির-ধনুক পরিচালনা শেখার পরও অবজ্ঞাবশত তা ছেড়ে দিল, সে যেন একটি উত্তম নেয়ামত ত্যাগ করল। অথবা তিনি বলেছেন, নেয়ামত অস্বীকার করল ও অকৃতজ্ঞ হলো। (সুনানে আবু দাউদ : ২৫১৩)। উল্লেখিত হাদিসে তিন প্রকার খেলাকে ‘অনর্থক বিনোদন’-এর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ এগুলো উপকারী খেলা। তাই আধুনিক এই যুগেও ফুকাহায়ে কেরাম কোরআন-হাদিসের আলোকে ওইসব খেলাকে জায়েজ বলেছেন, যেগুলোতে দ্বীনি বা দুনিয়াবি কোনো উপকারিতা রয়েছে। পাশাপাশি ফুকাহায়ে কেরাম যেকোনো খেলা জায়েজ-নাজায়েজ হওয়ার জন্য কিছু নীতিমালা উল্লেখ করেছেন।

যেসব শর্তে খেলাধুলা জায়েজ

এক. আল্লাহর কোনো হুকুম পালনে উদাসীন না করা। মূলত যেসব খেলাধুলা সুস্থতা ও দৈহিক সক্ষমতার পক্ষে সহায়ক তা মৌলিকভাবে নাজায়েজ বা দোষণীয় নয়। কিন্তু প্রত্যেক বিষয়েরই একটা সীমারেখা আছে, যা লঙ্ঘন করা হলে সাধারণ মুবাহ ও বৈধ কাজ তো দূরের কথা, নেক আমলও শরিয়তের দৃষ্টিতে আর জায়েজ থাকে না। তাই যেকোনো খেলা বৈধ হওয়ার জন্য প্রধান একটি শর্ত হলো, খেলার প্রতি এতটা মত্ত ও নেশাগ্রস্ত না হওয়া, যা আল্লাহর হুকুম পালনে উদাসীন করে রাখে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে, যারা খেলাধুলা-কৌতুকাবহ কথা ক্রয় করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এটা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবনামনাকর শাস্তি।’ (সুরা : লোকমান-৬)।

দুই. খেলাকে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পেশা না বানানো। খেলাধুলা শরীরচর্চা, আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের জন্য। এটা জীবনের লক্ষ-উদ্দেশ্য হতে পারে না। একজন মোমিনের লক্ষ-উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত করা। সেটাই মূল এবং একমাত্র লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আয-যারিয়াত : ৫৬)। সুতরাং আল্লাহর ইবাদত ছাড়া বাকি সব প্রাসঙ্গিক এবং সে ইবাদত পালনের সহায়কের ভূমিকায় হতে হবে। তাই একজন মোমিন খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করবে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেহ-মনে প্রফুল্লতা অর্জন করে আল্লাহর ইবাদত করবে এই উদ্দেশ্যে। এমন উদ্দেশ্যে খেলাধুলা হলে সেটা নিছক খেলাধুলা নয়; বরং সাওয়াবের কাজও বটে।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে খেলাধুলা এখন আর নিছক খেলাধুলা নয়; বরং জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে এবং জীবনের অনেক প্রয়োজন ও বাস্তব সমস্যার চেয়েও তা বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া এটি এখন ব্যক্তিগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খেলাধুলাকে একটি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিণত করা হয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে জীবনের মূল লক্ষ আল্লাহর ইবাদত করা, তা বেমালুম ভুলে গেছে।

তিন. জুয়া ও বাজি মুক্ত হওয়া : যেসব খেলায় জুয়া বা বাজি হয় বা যেসব খেলাকে কেন্দ্র করে জুয়া বা বাজির আসর বসে সেসব খেলা জায়েজ নয়। বর্তমানে জুয়া-বাজির জন্য বিভিন্ন রকমের আসর বসে বিভিন্ন দেশে। ক্রিকেট, ফুটবলসহ ও অন্যান্য খেলাধুলার প্রতিযোগিতায়ও বাজি ধরা হয়। এগুলো সবই হারাম। ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও নবী করিম (সা.)-এর আগমনের সময় তৎকালীন মক্কায় নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল। তিনি সবগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তিরগুলো তো নাপাক শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা মায়িদা : ৯০)

চার. সতর আবৃত রাখার পাশাপাশি পর্দাসহ শরিয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘন না হওয়া। সবসময়ের মতো খেলাধুলার সময়ও পর্দা করা ও সতর আবৃত রাখা ফরজ। তাই যেসব খেলাধুলায় সতর আবৃত থাকে না কিংবা পর্দার বিধান লঙ্ঘন হয় যেমন ফুটবল খেলার সময় উরু খোলা থাকে এবং সতর খেলার কারণে শরীর প্রায় উলঙ্গ থাকে, তাই এজাতীয় খেলা জায়েজ নাই। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি নিজের উরু উন্মোক্ত করো না এবং কোনো জীবিত বা মৃতের উরুর দিকে দৃষ্টি দিও না’। (আবু দাউদ : ৪০১৭)

পাঁচ. খেলার মধ্যে দ্বীনি বা দুনিয়াবি কোনো উপকারিতা থাকা। যেমন শারীরিক ব্যয়াম ইত্যাদি। শুধু অনর্থক কালক্ষেপণের জন্য হলে ইসলাম তা সমর্থন করে না। ইসলাম সর্বদা অনর্থক কাজকে অনুৎসাহিত করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সফল মোমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, (সফল মোমিন তারা) যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে। (সুরা মু’মিনুন : ৩)। অর্থাৎ-অনর্থক কথা অথবা কাজ, যাতে কোনো ধর্মীয় ও দুনিয়াবি কোনো উপকার নেই। হাদিস শরিফে অনর্থক বিষয়াদি পরিহার করাকে ইসলামের সৌন্দর্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষের জন্য সৌন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক বিষয়াদি পরিহার করা। (তিরমিজি : ২৩২০, তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিমণ্ড৪/৪৩৫ করাচি)।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমান বিশ্বে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যেসব খেলাধুলা হয় সেগুলোতে এই শর্তগুলোর কোনটি পাওয়া যায় না। বরং বর্তমানে ক্রিকেট, ফুটবলসহ প্রায় সব খেলাতেই ইসলামের মৌলিক অনেক বিধান লঙ্ঘন হয়। তাই এসব খেলাকে জায়েয বলা যায় না।

কোনো দলকে সমর্থন করা এবং খেলা দেখা

এসব খেলায় কোনো দলকে সমর্থন করা এবং টিভিতে কিংবা সরাসরি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে এসব খেলা দেখাও জায়েজ হবে না। কারণ সেখানে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা, পর্দার লঙ্ঘন, গান-বাজনাসহ শরিয়তের অনেক বিধান লঙ্ঘন হয়। নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করতে গিয়ে ব্যাপক জুয়া-বাজি হয় এবং দর্শকদের মাঝে ঝগড?া-বিবাদ, মারামারি এমনকি হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ (সুরা মায়িদা: ৯১)।

এছাড়া নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন ও তাদের খেলা দেখতে গিয়ে প্রচুর অর্থের অপচয় হয়। হাজার হাজার টাকা খরচ করে পতাকা, জার্সি ইত্যাদি ক্রয় করে নিজেকে প্রিয় দলের সাজে সজ্জিত করে। নিজের সমর্থিত দলের প্রশংসা করতে গিয়ে কাফের মুশরিকদের সাপোর্ট এবং তাদের প্রশংসা করতে হয়। সমর্থিত দলের জয়ে আনন্দ উল্লাস, হাততালি, মিছিল ইত্যাদি করে থাকে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে আল-উরস ইবনু আমীরাহ আল-কিনদী (রা.) সূত্রে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন, কোনো স্থানে যখন অন্যায় সংঘটিত হয়, তখন সেখানে উপস্থিত ব্যক্তি তাতে অসন্তুষ্ট হলে, সে অনুপস্থিতিদের মতোই গণ্য হবে (তার গোনাহ হবে না)। আর যে ব্যক্তি অন্যায় কাজের স্থান থেকে অনুপস্থিত হয়েও তাতে সন্তুষ্ট হয়, সে অন্যায়ে উপস্থিতদের অন্তর্ভুক্ত। (আবু দাউদ : ৪৩৪৫)। অন্য হাদিসে ইবনু উমার (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে। (আবু দাউদ : ৪০৩১)। বোখারির এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষ যাকে ভালোবাসে সে তারই সাথি হবে। (বোখারি : ৬১৬৯)। সর্বোপরি এসব খেলাধুলা মানুষকে দ্বীন ইসলাম এবং আখেরাতের চিন্তা থেকে গাফেল করে রাখে। তাই এসব খেলা দেখা এবং নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন জানানো জায়েজ নয়।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত