সময় বহমান স্রোতের মতো। সময়কে কখনও বেঁধে রাখা যায় না। পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’। নতুন বছরটি মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত একটি বছরের পর্যালোচনা ও নতুন এক বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা সচেতন মোমিনের ঈমানি দায়িত্ব। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২.০১ মিনিটকে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ নামে অভিহিত করা হয়। আমরা এটাকে ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে জানলেও মূলত তা ইংরেজি নববর্ষ নয়, বরং এটা খ্রিষ্টীয় বা গ্রেগরিয়ান নববর্ষ। যার সঙ্গে মিশে আছে খ্রিষ্টানদের ধর্ম ও সংস্কৃতি। এর নামকরণও করা হয়েছে খ্রিষ্টানদের ধর্মযাজক পোপ গ্রেগরিয়ানের নাম অনুসারে।
ঐতিহাসিকরা বলেন, প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশিদ খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে নববর্ষ প্রবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাবিলনের সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে ইংরেজি নববর্ষ প্রচলন করেন। প্রথম দিকে নববর্ষ বিভিন্ন তারিখে উদযাপিত হতো। পরে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর পহেলা জানুয়ারিতে নববর্ষ উদযাপনের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় আজও বিশ্বব্যাপী ইংরেজি নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করা হয়।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বর্তমান সময়ে এই উৎসবটি বিধর্মীদের পাশাপাশি মুসলিমরাও বিভিন্নভাবে উদযাপন করছে। বিশেষভাবে মুসলিম যুব সমাজের মাঝে এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। যেমন ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। এছাড়া, এ রাতে মহল্লায় মহল্লায় কিংবা বিভিন্ন শহরের অলিতে-গলিতে কিছু মুসলিম নামধারী যুবসমাজ গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য, আতশবাজি ফোটানো, ফানুস ওড়ানো, ডিজে পার্টি ও কনসার্ট প্রভৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে এই উৎসবটি উদযাপন করছে। এমনকি এই উৎসব পালনের নামে সমাজের অসংখ্য ছেলে ও মেয়েদের মাঝে অবাধ চলাফেরা লক্ষ্য করা যায়, যার মাধ্যমে জেনার দ্বার উন্মোচিত হয়। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে এরশাদ করেন, আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)।
ধর্মীয় ও দেশজ সংস্কৃতি নিজ নিজ ধর্ম ও দেশের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবি। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অন্য ধর্মের প্রথা বা বিদেশি সংস্কৃতি উদযাপন নিজ ধর্ম ও দেশজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা প্রকাশ। এটা কিছুতেই কাম্য নয়। ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপন দেশ ও ধর্মের উৎসব-সংস্কৃতির দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশের নাগরিক ও মুসলিম হিসেবে আমাদের জন্য বড়ই লজ্জার বিষয়। ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপন ইসলামে বৈধ নয়।
ইসলামি আইনবিদরা একে হারাম বলে আখ্যায়িত করেন। অন্য ধর্মের সংস্কৃতি-উৎসব মুসলমানের জন্য উদযাপন করা জায়েজ নেই। নিজ ধর্ম ও অন্য ধর্মের কালচারকে গুলিয়ে একাকার করতে বারণ করা হয়েছে হাদিসে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে, সে সেই জাতিরই অন্তর্ভুক্ত। (মিশকাত শরিফ : ৪৩৪৭)। অন্য ধর্মের সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি গ্রহণ না করার জন্য এ হাদিস মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করেছে। আর গ্রহণ করলে মুসলমানিত্ব হারানোর হুঁশিয়ারিও প্রকাশ পেয়েছে উপর্যুক্ত হাদিসটিতে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী, সাহাবিদের জীবনী, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেঈনদের জীবনী, চার ইমামের জীবনী, বিখ্যাত মুসলিম মনীষীদের জীবনী এবং বিভিন্ন ইসলামি খেলাফতের শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা কখনোই বিধর্মীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য এমন কোন উৎসব পালন করেননি, এমনকি থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক উৎসবটিও সমর্থন করেননি। যেমন হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে নবী) আপনি বলুন : নিশ্চয়ই আমার রব হারাম তথা নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অন্যায় ও অসংগত বিদ্রোহ ও বিরোধিতা এবং আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করা, যার পক্ষে আল্লাহ কোনো দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। (সুরা আরাফ : ৩৩)।
আলোচ্য আয়াত ও হাদিসটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, মুসলিম ব্যক্তিদের জন্য বিধর্মীদের এই উৎসবটি পালন আল্লাহর পক্ষ হতে সম্পূর্ণ হারাম তথা নিষিদ্ধ এবং যদি কেউ পালন করে তাহলে সে তাদের তথা বিধর্মীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই আমাদের সবার উচিত বিধর্মীদের এই সংস্কৃতিকে পরিহার করা এবং এটা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। পাশাপাশি নিজের সন্তান, পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ সবাইকে এই উৎসব পালন সম্পর্কে ইসলামের অভিমত অবহিত করা এবং সবাইকে সতর্ক করা। কেননা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে। (সুরা আত তাহরীম : ৬)।
পরিশেষে বলতে চাই, যে সময়টিতে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করা হয়, সে সময়টি ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার সময়। এ সময় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে এসে আহ্বানকারীকে (সাহায্য প্রার্থীকে), অসুস্থ ব্যক্তিকে, ক্ষমাপ্রার্থীকে (চাহিদা অনুযায়ী) যা ইচ্ছা তা ডেকে ডেকে দিয়ে যান। (মুসলিম, মিশকাত)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অন্ধকার রাতের ঘনঘটার মতো ফেতনার আগে দ্রুত আমল কর, (যখন) ব্যক্তি ভোর অতিবাহিত করবে মোমিন অবস্থায়, সন্ধ্যা করবে কাফের অবস্থায় অথবা সন্ধ্যা অতিবাহিত করবে মোমিন অবস্থায়, ভোর অতিবাহিত করবে কাফের অবস্থায়। মানুষ তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেবে দুনিয়ার সামান্য কিছুর বিনিময়ে।’ (মুসলিম)।
তাই এ সময়টিতে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে টগবগে যৌবনের লাগামছাড়া উন্মাদনা ও নেশা মেটানোর সময় হিসেবে বেছে নেয়া মারাত্মক অপরাধ। সুতরাং মোমিন মুসলমানের উচিত, থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক উৎসবে যোগদান কিংবা উদযাপন করা থেকে বিরত থাকা। ইসলাম নির্ধারিত বিধি-বিধান মেনে চলা। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক উৎসব থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি, কলাম লেখক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক