জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তাদানের লক্ষ্যে গৃহীত ও সংগঠিত কাজের সমষ্টিই সমাজসেবা। এছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমস্যা প্রতিরোধকল্পে গৃহীত ও সংগঠিত যাবতীয় কার্যক্রমও সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে সমাজসেবা কার্যক্রম কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইসলাম সব সৃষ্টির প্রতি দয়া ও কল্যাণ নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ হিসেবে সমাজসেবামূলক সব কার্যক্রম ইসলামে ইবাদাত হিসেগে গণ্য। তবে এটি হতে হবে নিঃস্বার্থ সমাজসেবা। ইসলামে সমাজসেবার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। যেমন- রোগীর চিকিৎসা করা, দুর্যোগপীড়িত মানুষের সেবা, যত্ন ও সাহায্য-সহযোগিতা করা, কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, অনাহারী মানুষের আহার জোগানো, পিপাসার্ত মানুষের পিপাসা নিবারণ, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান, অসহায়, নিঃস্ব ও দরিদ্রদের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করা, আশ্রয়হীন ও কর্মক্ষম ও প্রতিবন্ধী মানুষের পুনর্বাসন, দারিদ্র্য বিমোচন, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও সেতু নির্মাণ, পরিবেশ উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস দূরীকরণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি স্থাপন এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান প্রভৃতি সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজসেবা কার্যক্রম শুধু মানবিকই নয়; বরং একটি মৌলিক দায়িত্ব। মুসলিমদের জন্য এটি উম্মাহগত পরিচয়ও বটে। শুধু তা-ই নয়, এ সমাজসেবা হচ্ছে ইসলামি দাওয়াতের ভূমিকাস্বরূপ। হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) সমাজসেবার মাধ্যমে আরবের জনমানুষের হৃদয় ও মন জয় করেছিলেন- যা নবুয়তপ্রাপ্তির পর দাওয়াতি কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
‘হিলফুল ফুজুল’ নামে কল্যাণ সংস্থার সেবাকর্ম দ্বারা নবী (সা.) এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, লোকেরা তাঁকে ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। নবীর সেবাধর্মী চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন। মেহমানের সমাদর করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ (বোখারি)।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের সমাজসেবামূলক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। বান্দার হক তথা আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও গরিব-দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং আর্তমানবতার সেবা, সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে।
বস্তুত আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, দরিদ্র, নিঃস্ব, এতিম, নিরাশ্রয়, রোগী ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে যথাযথ সেবা করা খুবই সওয়াবের কাজ। আর এতে অমনোযোগী হওয়া আল্লাহপাকের অসন্তুষ্টি ও গোনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না এবং বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না- যারা কৃপণতা করে, মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন, তা গোপন করে।’ (সুরা নিসা : ৩৬-৩৭)।
হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার হাসিমুখে তাকানো একটি সদকা, কাউকে ভালো কাজ করার জন্য তোমার নির্দেশ দেওয়া একটি সদকা, কাউকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখাও তোমার একটি সদকা, পৃথিবীতে পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে সুপথ দেখানোও তোমার জন্য একটি সদকা, যে ব্যক্তি চোখে কম দেখে তাকে সাহায্য করাও তোমার জন্য একটি সদকা, যদি রাস্তা থেকে পাথর-কাঁটা ও হাড় সরিয়ে দাও তাও তোমার জন্য একটি সদকা, তোমার বালতির পানি দ্বারা তোমার ভাইয়ের বালতি ভরে দেয়াও একটি সদকা।’ (সুনানে তিরমিজি)।
অতএব, ইহকালের শান্তি ও পরকালীন নাজাতের জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই সাধ্যমতো সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে। এ সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, তা নিচে আলোকপাত করা হলো-
বিশেষ তহবিল গঠন করে দেশের দানবীর ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে জাকাত, ওসর, ফেতরা, কোরবানির চামড়া ও ত্রাণসামগ্রী বা আপৎকালীন ব্যয় বাবদ অর্থ আদায় করে বিশেষ তহবিলে জমা করতে হবে।
সমাজসেবা খাতের জন্য আদায়কৃত অর্থ-সামগ্রী কেন্দ্রীয় বিশেষ তহবিলে পাঠাতে হবে। কেন্দ্রীয় সংগঠন শরিয়তসম্মত উপায়ে সমাজসেবামূলক কাজে এ অর্থ ব্যয় করবে। পাশাপাশি আইন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করে এর মাধ্যমে ন্যায্য অধিকার রক্ষায় বিচারপ্রার্থীকে আইনি সহায়তা দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান ও সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত, জরুরি মাসায়েল শেখার ব্যবস্থা করতে হবে।
গ্রাম-গঞ্জের মানুষের সব সময় কাজ থাকে না। তাই এ রকম একটি মাস বেছে নিয়ে কোনো মসজিদে মাসব্যাপী এ ধরনের বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। মাগরিব বা এশার নামাজের পরে সম্ভব হলে প্রতিদিন অথবা সপ্তাহে অন্তত তিন বা চার দিন ক্লাস নেয়া যেতে পারে। নিজেদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞ কোনো দায়িত্বশীল ক্লাস নেবেন অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়েও ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে হজরত রাসুলে আকরাম (সা.)-এর একটি হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা নবী (সা.) মসজিদে নববিতে দুটি মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এরশাদ করলেন, এ দুটি দলই ভালো কাজে রত আছে, তবে একদল অন্য দলের চাইতে উত্তম। এ দল আল্লাহকে ডাকছে এবং তার দিকে মনোনিবেশ করছে। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন তো উত্তম প্রতিদান দেবেন, আর যদি ইচ্ছা করেন কিছু নাও দিতে পারেন। আর ওই দল ধর্মতত্ত্ব ও জ্ঞান আহরণ করছে এবং অজ্ঞদের শিক্ষা দিচ্ছে, তারা উত্তম। বস্তুত আমি নিজেও শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। এই বলে তিনি শিক্ষার্থী দলের সঙ্গে বসে পড়লেন।’ (দারেমি)।
দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে অসহায় রোগীদের মধ্যে ফ্রি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা করা যেতে পারে। খুব স্বল্প ব্যয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধপথ্যের সাহায্যে দাতব্য চিকি?ৎসালয় স্থাপন করা যায়। তাছাড়া রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানোসহ চিকিৎসকরা ফ্রি-ফ্রাইডে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই এ কাজ করতে পারেন।
এমনকি বৃক্ষরোপণও একটি উত্তম সেবা ও সওয়াবের কাজ। রাস্তার পাশে ও পতিত জমিতে গাছ লাগিয়ে সৃষ্টিকুলের খেদমত করা যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা শস্য জন্মায় অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি বা পশু (ফল-ফসল) ভক্ষণ করে, তাহলে সেটি তার জন্য সদকাস্বরূপ গণ্য হবে।
আর মহানবী (সা.) সামাজিক সেবাকে জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা বিধবা এবং গরিবের উন্নতির জন্য কাজ করে, তারাই যেন আল্লাহর পথে জিহাদের মতোই কাজ করল।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা দান করো, সাহায্য করো এবং নিজেদের আগুন থেকে রক্ষা করো, সে দিন পর্যন্ত যখন তোমরা সামান্যতম সময়ও পাও।’
মহানবী (সা.) তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন সময় দান ও বদান্যতা সম্পর্কে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছেন, ‘যে কেউ কোনো ঈমানদারের দুঃখ দূর করবে, আল্লাহ বিচারের দিন তার একটি কষ্ট লাঘব করে দেবেন। যে কেউ কোনো গরিব বা অভাবী মানুষের অভাব দূর করবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার অনেক সমস্যা দূর করে দেবেন। যে কেউ কোনো মুসলমানকে আশ্রয় দেবে, আল্লাহ এখানে ও পরপারে তাকে আশ্রয় দেবেন। যে তার ভাইকে সাহায্য করে আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন।’
আল্লাহর নবী (সা.)-এর এসব উদ্দীপনামূলক ও গঠনমূলক বক্তব্য শুনে সাহাবিরা অভাবী ও অসহায় লোকদের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন।
পরিশেষে বলতে চাই, সমাজসেবা একটি ইবাদত। এ সেবার মাধ্যমে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষের মতো অধঃপতিত কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। তাছাড়া এ সেবা কার্যক্রম প্রত্যেকেই চালিয়ে যেতে পারে। আইনজীবীরা আইন মারফত মজলুমের সাহায্য করে, তাদের মামলা-মোকদ্দমায় বিনা পারিশ্রমিকে সহায়তা করতে পারে। ডাক্তাররা প্রাথমিক ওষুধপথ্যের মাধ্যমে এবং ফ্রি চিকিৎসা ও অতিরিক্ত ফি না নিয়ে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে। এ রকম প্রতিটি সেক্টর থেকেই নিজ নিজ পরিসরে এ মহান সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। কোরআন কারিমে ঈমানের সঙ্গে যে আমালে সালেহকে সংযুক্ত করা হয়েছে অধিকাংশ স্থানে- তা বাস্তবায়নের জন্য অন্যতম প্রধান মাধ্যম এটি। তবে তার মধ্যে ঈমান ও ইখলাস থাকতে হবে। ইবাদাত কবুলের সব শর্তই এখানে প্রযোজ্য হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সব কাজ করার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : কলাম লেখক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক এবং প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি