রিংটোন হিসেবে কোরআনের আয়াত আজান ও সালাম ব্যবহারের হুকুম

মুফতি পিয়ার মাহমুদ

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মোবাইলের রিংটোন হিসেবে অনেকেই গানের বাজনা, গান ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। এটা যে নিন্দনীয় ও নাজায়েজ তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর বিপরীতে কিছু ভাই আজান, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের নিয়ত অবশ্যই ভালো। কিন্তু নিয়ত ভালো হলেও এ কাজটি ঠিক নয়। কারণ কোরআন আল্লাহর কালাম। কোরআন তেলাওয়াত অনেক বড় সওয়াব ও ফজিলতের আমল। কোরআন তেলাওয়াত শোনাও অনেক সওয়াবের কাজ। তেমনি আজান আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব ও তাসবিহ সংবলিত কিছু বাক্যের সমষ্টি, যা শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ শিআর বা প্রতীক। এগুলো নিজেদের কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। তাই এ বিষয়ে ইসলামি শরিয়তের সঠিক সিদ্ধান্ত জানা দরকার।

এ ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি হলো- আল্লাহতায়ালার নাম, কোরআনের আয়াত, আজান, সালাম বা দরুদ শরিফ ইত্যাদি কাউকে সতর্ক করার জন্য বা ডাকার জন্য ব্যবহার করা জায়েজ নেই। আর মোবাইলের রিংটোনও যেহেতু সতর্ক করা ও ডাকার সমার্থক, তাই মোবাইলের রিংটোন হিসেবে আল্লাহর নাম, আজান, সালাম, দরুদ শরিফ ও কোরআনের আয়াত ব্যবহার করা জায়েজ হবে না। সুতরাং এ জাতীয় কর্ম থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। মূলত মোবাইলের রিংটোন হিসেবে কোরআনের আয়াত, আজান, সালাম, আল্লাহু আকবার ইত্যাদির ব্যবহার নাজায়েজ হওয়ার উপরোক্ত কারণ ছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে। এখানে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো-

১. আজান আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ, বড়ত্ব ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য সংবলিত কিছু বাক্যের সমষ্টি, যা ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিআর বা প্রতীক। অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও আল্লাহতায়ালার নামের জিকির যে কত মর্যাদাপূর্ণ বিষয়, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে মোবাইলে রিং আসার অর্থ হলো, আপনাকে একথা অবহিত করা যে, কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এখন ‘কেউ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়’- এ খবরটুকু দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহর বড়ত্ব সংবলিত আজান ও মহামর্যাদাপূর্ণ কোরআনের আয়াত বা জিকির ব্যবহার করা কি আদৌ উচিত হবে? এসব আওয়াজকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাটা পবিত্র শব্দগুলোকে অবমাননা ও অপাত্রে ব্যবহার করার শামিল নয় কি?

কোনো বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য জোরে জোরে সুবহানাল্লাহ বলে কিংবা কোনো পাহারাদার যদি জোরে জোরে জিকির করার মাধ্যমে নিজের জাগ্রত থাকার বিষয়টি লোকজনকে অবহিত করে, তাহলে ফিকাহবিদরা একেও পবিত্র শব্দগুলোর অপব্যবহার বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং মাকরুহ বলেছেন। এবার আপনারাই চিন্তা করে দেখুন, এসব ক্ষেত্রে যদি জিকিরের ব্যবহার ‘পবিত্র শব্দগুলোর অপব্যবহার’ হয়ে থাকে, তাহলে ‘মোবাইলে কল এসেছে’- এ খবর দেওয়ার জন্য কোরআন তেলাওয়াত, আজান ইত্যাদির ব্যবহার কেমন হবে?

২. মোবাইল নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করার পর রিং এলে অপবিত্র স্থানে পবিত্র তেলাওয়াত, আজান, জিকির ইত্যাদি বেজে উঠবে। এতে এগুলোর পবিত্রতা কত মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

৩. রিংটোন হিসেবে কোরআন তেলাওয়াত ব্যবহার করলে অনেক সময় এমন হওয়া স্বাভাবিক যে, কে কল করেছে তা দেখা ও কল রিসিভ করার ব্যস্ততার দরুন তেলাওয়াতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার সুযোগ হয় না। অথচ আদব হলো, কোরআন তেলাওয়াত চলতে থাকলে কাজ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত শ্রবণ করা।

৪. কারও মোবাইলে রিং এলে সে যেহেতু রিসিভের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং রিসিভ করাই তার মূল উদ্দেশ্য থাকে, তাই আয়াতের যে কোনো স্থানেই তেলাওয়াত চলতে থাকে সেদিকে খেয়াল না করে রিসিভ করে ফেলে। ফলে অনেক সময় উচ্চারিত অংশের বিবেচনায় আয়াতের অর্থ বিকৃত হয়ে যায়। আর পবিত্র কোরআনের অর্থ বিকৃতি যে কত বড় গোনাহের কাজ, তা বলাই বাহুল্য!

মোটকথা, এমন বহু কারণেই আজান, জিকির, তেলাওয়াত ইত্যাদিকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। তবে হ্যাঁ, যে রিংটোনে গানের সুর বা বিশেষ কোনো তাল নেই, তা ব্যবহারে দোষের কিছু নেই। যেমন অনেক মোবাইলে ল্যান্ডফোনের আওয়াজের মতো বা সাইকেলের বেলের মতো রিংটোন থাকে- এ ধরনের রিংটোন ব্যবহারে দোষ নেই।

আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন। (আল আশবাহ ওয়ান্ নাযায়ের, পৃষ্ঠা- ৩৫, আল কাফী : ১/ ৩৭৬, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি : ৫/ ৩১৫, আততিবইয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কোরআন- ৪৬, রদ্দুল মুহতার : ১/ ৫১৮; হুক্কুত তিলাওয়া, শাইখ উসমান : ৪০১)।

লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, মোমেনশাহী

ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, মোমেনশাহী