প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.)-এর সঙ্গে একবার তার স্ত্রীর বেশ কথা কাটাকাটি হলো। বিষয়টি একটি পর্যায়ে ঝগড়ার দিকে চলে গেল। সচরাচর তারা এ ধরনের ঝগড়া করতেন না। হয়তো সেদিন শয়তান তাদের ওয়াসওয়াসা বেশি দিয়েছিল। তারা একে অপরের পুরোনো বিভিন্ন দুর্বলতা ও ভুলকে সামনে এনেও তর্ক করছিলেন। একটি পর্যায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) রাগ করে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। এমনকি মনে মনে তিনি স্ত্রীকে তালাক দেয়ারও চিন্তা করছিলেন।
এরপর তিনি একা একা নিজের মনেই হাঁটছিলেন। অনেকটা পথ তিনি এভাবেই হাঁটলেন। তিনি অনেক কিছু ভাবছিলেন। আল্লাহ কেন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন, আল্লাহ তার কাছে কি আশা করেন, তার এখন কী করা উচিত, রাসুলের (সা.) সুন্নতকে কীভাবে ধারণ করা যায়- এগুলোও তার মাথায় আসছিল। এভাবেই আনমনে তিনি যখন মদিনার রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন পথিমধ্যে তিনি কোনো একজন ব্যক্তিকে সুরা নিসার ১৯ নং আয়াতটি পড়তে শুনলেন। এই আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৯)।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ পুরুষ মোমিনদের আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে তারা স্ত্রীর নেতিবাচক গুণাবলির তুলনায় বরং ইতিবাচক গুণাবলিগুলোকেই বেশি মূল্যায়ন করে। হতে পারে, এই নেতিবাচক বিষয়াগুলোই ভবিষ্যতে হয়তো ইতিবাচক হিসেবে আবির্ভূত হবে।
চিন্তা করে দেখুন, কী অদ্ভুত ঘটনা। যখন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) স্ত্রীর ওপর রাগ করে বের হয়ে গেছেন, তাকে ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন, ঠিক এমনই একটি সময়ে কোরআন মজিদের সেই আয়াতটি তার কানে এলো, যেখানে আল্লাহ স্বামীদেরকে স্ত্রীদের ইতিবাচক গুণাবলির দিকে নজর বেশি দিতে বলেছেন। মানসিকভাবেও ইতিবাচক থাকতে বলেছেন।
এই আয়াতটি শুনেই আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তার করণীয় বুঝে ফেললেন। তিনি বাসায় চলে গেলেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে আপস করে নিলেন। স্ত্রীকে তিনি আর তখন তালাক দিলেন না বরং একটু আগের ঝগড়ার ঘটনার জন্য অনুতপ্তও হলেন।
এর কিছু দিন পরই হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) স্ত্রী গর্ভবতী হন। তার গর্ভে একটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হয়- যার নাম ছিল সালেম। অর্থাৎ প্রচণ্ড ঝগড়ার পর যখন তিনি পুনরায় সম্পর্ক মেরামত করে ফেললেন, তখন এই দম্পতিকে আল্লাহতায়ালা উপহার হিসেবে একটি সন্তান দান করলেন। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) সব সন্তান-সন্ততির মধ্যে সালেমই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। এই সালেম পরবর্তী সময়ে মদিনার শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার হিসেবে আবির্ভূত হন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) আর কোনো সন্তান এত বেশি জ্ঞান ও পা-িত্য অর্জন করতে পারেনি। তার বর্ণনায় অসংখ্য হাদিস ও হাদিসের বিশ্লেষণও পাওয়া যায়।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) অসাধারণ জীবনের সবচেয়ে উত্তম ধারাবাহিকতা তার এই সন্তানটি বহন করতে পেরেছিলেন। আর সেই কারণেই, যখনই আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এই সালেমকে দেখতেন, তিনি বলতেন ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন, আল্লাহ সত্য বলেছেন।’
কারণ, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) অনুভব করতেন, যদি তিনি তার স্ত্রীকে সত্যি সত্যি তালাক দিতেন তাহলে হয়তো সালেমের মতো এই উত্তম সন্তানের পিতা হওয়া থেকে তিনি বঞ্চিতও হতে পারতেন। আর তিনি এও উপলব্ধি করতেন যে, স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য দূর করার পুরস্কার হিসেবেই আল্লাহ তাদেরকে এই সন্তানটি দান করেছেন।
এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই, তালাকের মতো বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা সমীচীন নয়। বরং আমার জীবনসঙ্গীর যতটুকু দুর্বলতা চোখে পড়ে তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না থেকে বরং ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। সর্বোপরি, বিয়ের আগেই একটি মেয়েকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে চিন্তা করা প্রয়োজন, কেন আমি এই মানুষটিকে বিয়ে করতে চাইছি। তার সঙ্গে বিয়ে হলে আল্লাহর পথে থাকা বা আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ করা সম্ভব হবে কি-না, এ বিষয়গুলো ভাবা দরকার। আর বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের জীবনসঙ্গীর ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি মূল্যায়ন করা উচিত।
আল্লাহ আমাদেরকে কোরআনের উপরোক্ত আয়াত পালনের তৌফিক দিন। কোরআনের চেতনার আলোকে জীবনকে সাজানোর সামর্থ্য দিন। আমিন।
সংগ্রহ : আলী আহমদ মবরুর