নামাজে মোবাইল ফোন কিছু জরুরি মাসআলা

মুফতি পিয়ার মাহমুদ

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এখন প্রায় প্রতিটি মসজিদের একই চিত্র যে, জামাতে নামাজ চলা অবস্থায় নামাজির মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। নামাজ অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু যে তার নামাজেরই বিঘ্ন ঘটায় এমন নয়; বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুযু বিঘ্নিত হয়। নামাজ অবস্থায় মসজিদে যেহেতু পিন পতন নীরবতা বিরাজ করে, তাই মোবাইল বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সবার ধ্যান-খেয়াল চলে যায় মোবাইলের রিংটোনের দিকে। অথচ নামাজ অন্য সব ইবাদত থেকে ভিন্ন ধরনের একটি ইবাদত। এ ইবাদতটি হলো সরাসরি আল্লাহতায়ালার দরবারে হাজিরা দিয়ে তাঁর মহান সত্তার সামনে দণ্ডায়মান হয়ে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের এক অপূর্ব মুহূর্ত। এ কারণেই নামাজ অবস্থায় একাগ্রতা ও খুশুখুযুর প্রতি যেভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় তেমনটি করা হয়নি। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ওই সব মোমিন সফলকাম, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র।’ (সুরা মুমিনুন : ১-২)।

তাই একজন নামাজির উচিত মসজিদে প্রবেশের আগেই মোবাইল একেবারে বন্ধ না করলেও অন্তত রিংটোন বন্ধ করে দেওয়া। এ অবস্থায় মোবাইলে ভাইব্রেশন দিয়ে রাখা ঠিক নয়। কারণ, ভাইব্রেশন দিয়ে রাখলেও কল আসলে নামাজির মনোনিবেশ নষ্ট করে। এতে অন্যের নামাজের ক্ষতি না হলেও নিজের নামাজের খুশুখুযু নষ্ট হয় অবশ্যই। তাছাড়া মোবাইলটি তখন পার্শ্ববর্তী মুসল্লির শরীরে স্পর্শ করলে তারও নামাজের একাগ্রতা নষ্ট হবে। তাই ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়, বরং হয়তো সাইলেন্ট করে রাখবে, কিংবা একেবারে বন্ধ করে দেবে। কোনো কারণে যদি নামাজের আগে মোবাইলের রিং বন্ধ করা না হয় আর নামাজ পড়া অবস্থায় রিং বেজে ওঠে তখন করণীয় ও লক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো নিম্নরূপ :

১. দুই হাত ব্যবহার না করে নামাজের আপন অবস্থাতে থেকেই এক হাতের সাহায্যে মোবাইল পকেটে রেখেই কোনো বাটন চেপে রিং বন্ধ করে দেবে। আর পকেট থেকে বের করার প্রয়োজন হলেও এক হাত দ্বারাই করবে। মোবাইল বের করে পকেটের কাছে রেখেই না দেখে দ্রুত বন্ধ করে পকেটে রেখে দেবে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, নামাজে প্রয়োজনে এক হাত কোনো কাজে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। যেমন, টুপি ওঠানোর জন্য, জামার হাতা নামানোর জন্য, সিজদার স্থানের কংকর সরানোর জন্য, শরীরের কোনো স্থান বিশেষ প্রয়োজনে চুলকানোর জন্য ইত্যাদি। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/৫৬৪, শরহুল মুনিয়াহ : ৪৪৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১০৫, খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৪, শরহে নববী : ১/২০৫)।

২. এক হাত দ্বারা বন্ধ করতে গিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে দেখে বন্ধ করা যাবে না। কারণ, এমনটি করলে যদিও দুই হাত ব্যবহার হচ্ছে না; কিন্তু মোবাইল ফোন দেখে দেখে বন্ধ করা অবস্থায় এ ব্যক্তিকে কেউ দেখলে সে নামাজে আছে বলে মনে করবে না। আর নামাজ অবস্থায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নামাজ ভেঙে যায়। তাই নামাজ অবস্থায় মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২)।

৩. নামাজে মোবাইল ফোন বন্ধের জন্য একসঙ্গে দুই হাত ব্যবহার করা যাবে না। যদি একসঙ্গে দুই হাত ব্যবহার করে, তবে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২)।

৪. সিজদাবস্থায় রিং বেজে উঠলে কেউ কেউ সিজদা থেকে প্রায় বসে গিয়ে মোবাইল ফোন বের করে বন্ধ করে থাকে। অথচ তখনও ইমামণ্ডমুসল্লি সবাই সিজদাতেই থাকে। নামাজের এ অবস্থা থেকে মোবাইল ফোন বন্ধের জন্য বসে যাওয়াতে নামাজ ভেঙে যাবে। যদিও মোবাইল বন্ধ করাতে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় ব্যয় না হয়। কারণ, যেখানে দুই হাতের ব্যবহারকেই নামাজ ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে, সেখানে পুরো শরীরকে নামাজের অবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে নামাজ ভঙ্গের কারণ হবে। এ ছাড়া এই অবস্থায় কোনো আগন্তুক তাকে দেখলে সে নামাজে নেই বলেই মনে করবে। এটিও আমলে কাসিরের অন্তর্ভুক্ত, যা নামাজ নষ্টকারী।

৫. তিনবার বিশুদ্ধভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ বা ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ বলা যায়- এ পরিমাণ সময়ের ভেতর উপরন্তু দুইবার পর্যন্ত এক হাতের সাহায্যে উপরোক্ত ১ নং-এ উল্লেখিত নিয়মে রিং বন্ধ করা যাবে। এ সময়ের ভেতর দুইবারের বেশি বন্ধ করা যাবে না। যদি করে তবে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, একবার বা দুইবার বন্ধ করার পর তিন তাসবিহ পরিমাণ বিলম্বে আবার রিং বেজে উঠলে তখন বন্ধ করা যাবে। মোটকথা তিন তাসবিহ বলা যায় এ সময়ের ভেতর তিনবার রিং বন্ধের জন্য এক হাতও ব্যবহার করা যাবে না। এতে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৩/৪১৮-৪১৯)।

৬. মোবাইল প্যান্টের পকেটে থাকলে তা বের করে বন্ধ করার জন্য দুই হাত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। তদ্রুপ ফোল্ডিং সেট হলেও রিং বা ফোন বন্ধ করতে কখনও কখনও দুই হাত ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। অথচ দুই হাত ব্যবহার করলে নামাজ ভেঙে যায়। তাই এক্ষেত্রে কি নিজের নামাজ নষ্ট করে হলেও রিং বন্ধ করবে? নাকি করবে না? মূলত নামাজে খুশুখুযুর গুরুত্ব এতই বেশি যে, কোনো নামাজির মলমূত্রের বেগ হওয়ার দরুন খুশুখুযু বিঘ্নিত হলে তার জন্য নামাজ ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফিকহের কিতাবাদিতে এ ক্ষেত্রে নামাজ ছেড়ে দেওয়াকে উত্তম বলা হয়েছে। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। (তাহতাবী আলাল মারাকী : ১৯৮, হিন্দিয়া : ১/১০৭, আল বাহরুল রায়েক : ১/২৮৭, রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৪)।

তাহলে নামাজ অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু তার নামাজেরই বিঘ্ন ঘটায় না বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুযু বিঘ্নিত হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে নামাজ নষ্ট না করে বন্ধ করা সম্ভব না হলে নামাজ ছেড়ে দিয়ে হলেও মোবাইল বন্ধ করা জায়েজ তো বটেই; বরং এমনটি করাই কর্তব্য। আর রিংটোন যদি গান বা মিউজিকের হয়, তবে এর খারাবি তো আরও অধিক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নামাজে থেকে উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী একহাত দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হলে তাই করবে। আর তা সম্ভব না হলে নিজের নামাজ ছেড়ে দিয়ে হলেও রিং বন্ধ করে দেবে। অতঃপর মাসবুকের মতো আবার নতুন করে জামাতে শরিক হবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৫)।

লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, তালতলা, মোমেনশাহী এবং ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, মোমেনশাহী