মোনাজাত; মহান বরের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা। মানুষের সব সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সম্পর্ক। ঘনিষ্ঠতম এ দুই সম্পর্কের মধ্যে থাকে নানান কথাবার্তা, আবেদন-নিবেদন, অনুযোগ-অভিযোগ ও প্রার্থনা। তাই বান্দার প্রয়োজন আল্লাহতায়ালার কাছে মোনাজাত করা। আল্লাহ তো বড়, মহান, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় লিপ্ত হওয়া কি সোজাকথা! তার কাছে মোনাজাত করতে হলে তার বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও প্রতাপশালিতার দিকে লক্ষ্য করে পরিপূর্ণ আদব-ইহতেরাম বজায় রেখে মোনাজাত করতে হয়। তবেই তিনি বান্দার মোনাজাতে সাড়া দেন। প্রার্থনা কবুল করেন। যেভাবে মোনাজাত করলে দ্রুত কবুল হয়, সে সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় সংক্ষিপ্ত আকরে তুলে ধরা হলো।
১. হালাল রিজিক : মানুষ যে খাবার গ্রহণ করে তার প্রভাব পড়ে সেই খাদ্য দ্বারা গঠিত শরীরে। হালাল খাবারের বরকতে মুসলমান নেক আমলের প্রতি আগ্রহী হয়। আর হারাম খাদ্যের প্রভাবে বান্দা বদ আমলের প্রতি ঝুঁকতে থাকে। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহতায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেরিত রাসুলদের যে হুকুম দিয়েছেন, মোমিনদেরও সে হুকুম দিয়েছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘হে রাসুলরা! তোমরা পবিত্র ও হালাল জিনিস আহার কর এবং ভালো কাজ কর। আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত।’ [সুরা আল মু’মিনুন : ৫১]। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ শোন! আমি তোমাদের যেসব পবিত্র জিনিস রিজিক হিসেবে দিয়েছি তা খাও।’ [সুরা আল বাকারাহ : ১৭২]। (সহিহ মুসলিম : ২২৩৬)।
২. আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস : মোমিন বান্দা যখন দোয়া করবে, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে দোয়া করবে। আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একথা মনে রাখবে। এই বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করবে যে, আল্লাহ অবশ্যই আমার দোয়া কবুল করবেন।
৩. হামদ পাঠের দ্বারা দোয়া শুরু করা : দোয়া শুরু করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওপর হামদ পাঠের দ্বারা। যথাসাধ্য বেশি পরিমাণ প্রশংসা করার চেষ্টা করবে। কাকুতি-মিনতি ও আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে দোয়া করবে।
৪. রাসুল (সা.)-এর শানে দরুদ ও সালাম পেশ করা : আখেরি নবী মুহাম্মদে আরবি (সা.) এর শানে দরুদ ও সালাম পেশ করবে। দরুদ শরিফ হলো নবীজির জন্য দোয়া। তাই আগে দুরুদণ্ডসালাম পাঠ করে পরে নিজের জন্য দোয়া করা।
৫. দোয়া কবুলের স্থানে বসে দোয়া করা :? দোয়া কবুলের সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদ। মসজিদে বসে দোয়া করে বার্ধক্যকালে হজরত জাকারিয়া (আ.) সন্তান লাভ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : ‘সেখানে (মসজিদে) বসে দোয়া করলেন জাকারিয়া। (তার দোয়া হলো) হে আমার রব! আমাকে উত্তম সন্তানসন্তুতি দান করুন। আপনি তো দোয়া কবুলকারী। তিনি মসজিদে নামাজ আদায় করা অবস্থায় এক ফেরেশতা এসে তাকে পুত্রসন্তান ইয়াহইয়া এর সুসংবাদ দিল।’
৬. আল্লাহর সিফতি নামগুলোর উসিলা দিয়ে দোয়া করা : আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সিফতি নামগুলোর উসিলা দিয়ে দোয়া করা। কোরআনে এরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহর রয়েছে অসংখ্য সিফাতি নাম। তোমার সেসব নামের উসিলায় দোয়া করো।’
৭. নেক আমল করে দোয়া করা : বেশি বেশি নেক আমল করে দোয়া করা এবং দোয়া কবুল হওয়ার আশা নিয়ে দোয়া করা। আর ইবাদত করার সময় পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে দোয়া করা।
৮. উত্তম হালতে থাকা অবস্থায় দোয়া করা : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে লোক বিপদাপদ ও সংকটের সময় আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ লাভ করতে চায় সে যেন সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্যের সময় বেশি করে দোয়া করে।
৯. একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা : একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা। অন্য কারও মুখাপেক্ষী না হওয়া। অনুরূপভাবে দোয়া করতে করতে যেন কোনো ফরজ, ওয়াজিব না ছুটে সেদিকে খেয়াল রাখা।
দোয়া কবুলের মুহূর্ত
মোমিনের দোয়া যে কোনো হালতেই কবুল হয়। কোরআনে এরশাদ হয়েছে : ‘প্রার্থনাকারী যখনই প্রার্থনা করে আমি তা কবুল করি।’ বেশ কয়েকটি সময়ের ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, সেই সময়গুলোতে দোয়া দ্রুত কবুল হয়। নিম্নে কয়েকটি সময় তুলে ধরা হলো-
এক. আজান ও একামতের মধ্যবর্তী সময় । হাদিস শরিফে এসেছে; আজান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।
দুই. সিজদারত অবস্থায় দোয়া করা। কেননা, সিজদার হালতই হলো বান্দার জন্য রবের আবদিয়্যাত প্রকাশের সর্বোত্তম হালত।
তিন. ফরজ নামাজের পর। হাদিসে এসেছে : মাগরিবের নামাজ শেষ করে অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার আগে এই দোয়া সাতবার পড়- ‘আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান্নার’। তারপর এই রাতে মৃত্যু হলে তুমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। অনুরূপ ফজরের পর পড়ো। তারপর এই দিনে মৃত্যু হলে তুমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।
চার. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। ইফতারের আগ মুহূর্তে রোজাদার কোনো দোয়া করলে আল্লাহ তা ফিরিয়ে দেন না। নবীজি (সা.) ফরমান : প্রত্যেক রোজাদারের জন্য একটি মকবুল দোয়া বরাদ্ধ রয়েছে। আর তা হলো ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। হয়তো তা দুনিয়াতে দেয়া হবে অথবা আখেরাতে তার দোয়া তার জন্য সঞ্চিত থাকবে।
পাঁচ. কোরআন তেলাওয়াত করে দোয়া করা। নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে সে যেন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।
ছয়. সফরে থাকা অবস্থায় দোয়া। নবীজি (সা.) ফরমান : তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। মজলুমের দোয়া। মুসাফিরের দোয়া। পিতার দোয়া।
সাত. দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদে নির্যাতিত অবস্থায় দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করেন।
আট. বৃষ্টি চলাকালীন দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহান রবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে একান্ত আলাপচারিতার তৌফিক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া সিদ্দীকিয়া (যাদুরচর মাদরাসা), সাভার, ঢাকা