দাওয়াত ও তাবলিগ
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহতায়ালা মানুষ আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : ‘আমি মানুষ আর জীন জাতি সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য’ এবং আল্লাহতায়ালা এই ইবাদতের রূপরেখা ও একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কোরআন। আল্লাহর এই শাশ্বত বিধান যথাযতভাবে মেনে চলার মধ্যেই উভয় জাহানের কল্যাণ নিহিত এবং চির শান্তি ও মুক্তির ঠিকানা। এই অনুভূতি সবার হৃদয়ে জাগিয়ে তুলতে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তারা পৃথিবীতে এসে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
হজরত আদম (আ.) থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবার মিশন ছিল এক ও অভিন্ন। পথভোলা মানুষগুলোর দ্বারে দ্বারে গিয়ে সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়া। ইসলামেই রয়েছে চির শান্তি সফলতা এই অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। রাসুল (সা.) জীবনের দীর্ঘ ২৩ বছর এই মিশন নিয়েই মানুষদের দাওয়াত দিয়েছেন। উম্মতের আত্মভোলা মানুষগুলোর জন্য এতটা হতাশা ও আফসোস প্রকাশ করতেন যেন তিনি প্রাণ বিনাশ করে দেবেন। আল্লাহ বলেন : ‘অতঃপর যদি তারা এই মর্যাদাপূর্ণ বাণীর ওপর ঈমান না আনে তাহলে আপনি তাদের জন্য দুঃখে আত্মা বিনাশ করে ফেলবেন?’ (সুরা কাহাফ : ৭)।
স্বজাতির আধ্যাত্মিক মঙ্গলের জন্য রাসুল (সা.)-এর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার একটি জোরাল প্রমাণ এই আয়াত। আত্মভোলা মানুষগুলো যখন রাসুলের দাওয়াত গ্রহণ না করে, সে ঐশী বাণী ও শিক্ষার বিরোধিতা এবং প্রত্যাখ্যান করত তখন এর মর্মযন্ত্রণা তাকে প্রায় মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দিত।
কিন্তু নবুয়তের ধারাবাহিকতা সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবেন না। তাই দাওয়াতের এই গুরুদায়িত্ব রাসুল (সা.) এই উম্মতের ওপর অর্পণ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলে কারিম (সা.) বলেন : ‘হে লোক সকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অনুপস্থিতদের এ বাণী পৌঁছে দেয়া।’ (বোখারি : ৪৪০৬)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন : আমার একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও। (বোখারি : ৩৪৬১)।
রাসুলের এই বাণী বাস্তবায়নে সাহাবায়ে কেরাম পৃথিবীর দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে মহাসত্যের এ বাণী পৌঁছে দেন। তাই তো দেখা যায় লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামদের মধ্য থেকে মাত্র অল্প সংখ্যক সাহাবির কবর মক্কা-মদিনায় পাওয়া যায়। আর বাকি সাহাবিদের কবর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত। দাওয়াতের কাজে যে যেখানে ইন্তেকাল করেছেন তাকে সেখানেই দাফন করে দেয়া হয়। সাহাবায়ে কেরামের এই ত্যাগ ও কোরবানির মাধ্যমেই সুদূর আরব থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের আলো পৌঁছেছে। সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং তৎপরবর্তী মুখলেছ বান্দারা বিভিন্ন উপায়ে, নানা পদ্ধতিতে এই দাওয়াত ও তাবলিগের আঞ্জাম দেন। তাবলিগ অর্থ হচ্ছে পৌঁছে দেয়া। ইসলামের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সৎ কাজের আদেশ করা অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করা।
এই উম্মতে মুহাম্মদির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্যের কারণ হচ্ছে এই দাওয়াত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষদের সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়মূলক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে এবং আল্লাহ ওপর ইমান আনবে।’ (আলে ইমরান : ১১০)। এই আয়াতে দাওয়াত ও তাবিলগকেই উম্মতে মুহাম্মদির শ্রেষ্ঠত্যের কারণ বর্ণনা করেছেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি আল্লাহতায়ালা নির্দেশও দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করবে। আর সৎ কাজের আদেশ করবে আর অন্যায় কাজে বাধা দেবে। তারাই হলো সফলকাম (সুরা আল ইমরান : ১০৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা দাঈদের উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে বলেন : ‘সে ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে, মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং নিজে সৎ কাজ করে আর বলে আমি মুসলামনদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা হা-মীম সিজদাহ : ৩৩)।
দাওয়াতের মাধ্যমেই আজ পুরো বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মহাসত্যের এই বাণী পৌঁছেছে। আলোকিত হয়েছে সারা বিশ্ব। দাওয়াতের মাধ্যমেই চৌদ্দশত বছর আগের সেই মক্কার ইসলাম পৃথিবী বিস্তৃত এবং এখনও অক্ষুণ্ন। এই দাওয়াতের শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকে স্রষ্টার আনুগত্যের প্রতি মনোনিবেশ করা এবং খালেকের সঙ্গে মাখলুকের পরিচয় করে দেয়ার মাধ্যমে আত্মভোলা মানুষগুলোকে সঠিক পথের দিশা দেয়া। এই দায়িত্ব আমার আপনার এবং উম্মতে মুহাম্মদি সবার।
তাছাড়া একজন মুসলিমের দায়িত্ব কেবল নিজেকে শরিয়তের অনুসারী বানানোর দ্বারাই শেষ হয়ে যায় না; বরং তার পরিবার, প্রতিবেশী এবং সমাজের মানুষগুলোকেও শরিয়তের অনুসারী করে তোলার জন্য চেষ্টা করা এবং তাদের কল্যাণের দিকে দাওয়াত দেয়াও তার দায়িত্ব। অন্যথায় শুধু নিজে শরিয়তের বিধান পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে না। সামগ্রিক আজাবে সেও পাকড়াও হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সামগ্রিক আজাব থেকে সতর্ক করে এরশাদ করেন, ‘আর তোমরা এমন ফ্যাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা বিশেষত শুধু তাদের ওপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে জালেম। জেনে রেখ যে, আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠোর।’ (সুরা আনফাল : ২৫)।
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদানরা! নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে রক্ষা কর সে আগুন থেকে যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, তাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতারা। আল্লাহতায়ালা যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয় তাই করে।’ (সুরা তাহরীম : ৬)। তাই সামগ্রিক আজাব থেকে বাঁচতে হলে শুধু নিজেই আমল করা যথেষ্ট নয়; পাশাপাশি পথভোলা মানুষগুলোকেও আল্লাহর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। দাওয়াত দিতে হবে।
হাদিস শরিফে বিষয়টিকে খুব সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝানো হয়েছে। নু’মান ইবনু বাশীর (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন, যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রী দলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচতলায়। (পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়) কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নিচতলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকেদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নেই (তবে ভালো হয়) এ অবস্থায় তারা যদি এদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে (বোখারি : ২৪৯৩)। আল্লাহতায়ালা আমাদের এই গুরুদায়িত্ব পালন করে শ্রেষ্ঠত্বের গুণ অর্জন করার তৌফিক দিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী