মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাঁর শরিক কাউকেও দাঁড় করাবে না, মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, কাছের সঙ্গী, পথচারী এবং আপন দাস-দাসীদের সঙ্গেও। নিশ্চয়ই আল্লাহর পছন্দ হয় না কোনো দাম্ভিক, আত্ম-গৌরবকারীকে।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। এই আয়াতের আলোকে তাফসিরে আহমদিয়ায় বর্ণিত রয়েছে : নিকটতম প্রতিবেশী দ্বারা তারাই উদ্দেশ্য, যাদের ঘর নিজের ঘরের সঙ্গে লাগানো এবং দূরবর্তী প্রতিবেশী দ্বারা তারাই উদ্দেশ্য, যারা একই মহল্লার অধিবাসী কিন্তু তাদের ঘর নিজের ঘরের সঙ্গে লাগানো নয়। অথবা যারা প্রতিবেশীও এবং আত্মীয়ও তারাই হলো নিকটতম প্রতিবেশী। আর যারা শুধু প্রতিবেশী, আত্মীয় নয়, তারা দূরবর্তী প্রতিবেশী অথবা যারা প্রতিবেশীও হবে এবং মুসলমানও হবে, তারাই হলো নিকটতম প্রতিবেশী আর যারা শুধু প্রতিবেশী হবে মুসলমান নয়, তারাই হলো দূরবর্তী প্রতিবেশী। (তাফসিরে আহমদিয়া, আন্ নিসা, ৩৬নং আয়াতের অধীনে, ২৭৫ পৃ:)।
ইসলাম কতই না উত্তম ধর্ম, যা শুধু আমাদের পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে উত্তম আচরণের শিক্ষা দেয় তা নয় বরং এও শেখায় যে, আমাদের নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত। কোরআন ও সুন্নাহর একাধিক স্থানে প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা এবং তাদের হকগুলো আদায় করার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন : ‘তোমাদের জানা আছে, প্রতিবেশীর হক কি? (অতঃপর নিজেই এরশাদ করেন) যখন তারা তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য চায়, তখন সাহায্য করবে এবং যখন কর্জ চায় তখন কর্জ দেবে। আর যখন মুখাপেক্ষী হয়, তখন তাকে দান করবে। যখন অসুস্থ হয়, তখন সেবা করবে। যখন সফলতা লাভ করে, তখন ধন্যবাদ দাও। যখন বিপদগ্রস্ত হয়, তখন তার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করো। মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজার সঙ্গে যাও। অনুমতি ছাড়া নিজের উচ্চ দালান নির্মাণ করিও না, যাতে তার বাতাস বন্ধ হয়ে যায় এবং সক্ষম হলে তোমার ডেকচি থেকে তাকে কিছু দাও, নতুবা তা দ্বারা তাকে কষ্ট দেবে না। আর যখন কোনো ফল লাভ করো, তখন তার কাছেও হাদিয়া পাঠিয়ে দাও। আর যদি হাদিয়া না দাও, তখন লুকিয়ে ঘরের মধ্যে নাও এবং তোমার সন্তানরা যেন তা নিয়ে বাইরে না যায়, যার কারণে প্রতিবেশীর সন্তানরা কষ্ট পায়। তোমাদের জানা আছে যে, প্রতিবেশীর হক কী? ওই সত্তার শপথ! যার কুদরতের হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! পরিপূর্ণভাবে প্রতিবেশীর হক আদায়কারীর সংখ্যা কম। তারাই (আদায় করে), যাদের ওপর আল্লাহতায়ালার দয়া রয়েছে। হুজুর (সা.) প্রতিবেশীদের সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমনকি লোকেরা মনে করেছিল যে, প্রতিবেশীদের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন। অতঃপর রহমতে আলম হুজুর (সা.) এরশাদ করলেন : প্রতিবেশী তিন ধরনের; কারও হক তিনটি, কারও হক দুটি এবং কারও হক একটি। যেসব প্রতিবেশী মুসলমান এবং আত্মীয়, তাদের হক তিনটি; প্রতিবেশীর হক, ইসলামের হক এবং আত্মীয়তার হক। মুসলমান প্রতিবেশীর হক দুটি; প্রতিবেশীর হক এবং ইসলামের হক। আর অমুসলিম প্রতিবেশীর শুধু একটি হক আর তা হলো প্রতিবেশীর হক। (শুয়াবুল ঈমান, বাবুন ফি ইকরামিল জার, ৭/৮৩-৮৪, হাদিস নং: ৯৫৬০)।
নবী করিম (সা.) আরও এরশাদ করেন : ‘অনেক প্রতিবেশী কেয়ামতের দিন তাদের প্রতিবেশীদের আঁচলগুলো ধরবে! অত্যচারিত প্রতিবেশী আরজ করবে : হে আল্লাহ! এই ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা করো! সে আমার ওপর তার দরজাগুলো বন্ধ করে রেখেছিল এবং নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বস্তু আমার কাছ থেকে বেঁধে রেখেছিল।’ (কানযুল উম্মাল, ৫/২৩ হাদিস নং : ২৪৮৯৮)।
এক ব্যক্তি আরজ করল ইয়া রাসুলাল্লাহ! অমুক মহিলার আলোচনা, তার নামাজ, সদকা এবং রোযার আধিক্যের কারণে করা হয়। কিন্তু সে তার মুখ দ্বারা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। তখন হুজুর (সা.) এরশাদ করেন : সে জাহান্নামি! লোকটি আবার আরজ করল : ইয়া রাসুলাল্লাহ! অমুক মহিলার নামাজ এবং রোজার স্বল্পতা রয়েছে এবং পনিরের টুকরো সদকা করার কারণে চেনা যায় এবং নিজেদের প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয় না। তখন তাজেদারে মদিনা (সা.) এরশাদ করেন : সে জান্নাতি। (মুসনদে আহমদ, ৩/৪৪১, হাদিস নং: ৯৬৮১)।
হাদিস শরিফের বর্ণনামতে, প্রত্যেক মুসলমানের পার্শ্ববর্তী চল্লিশ ঘরে বসবাসকারীরা তার প্রতিবেশী বলে গণ্য হবে। নবীজির দরবারে এক ব্যক্তি আরজ করল : ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি অমুক গোত্রের মহল্লার মধ্যে বসবাস করি, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে যে আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, সে আমার সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। তখন রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.) হজরত আবু বকর সিদ্দিক, হজরত ওমর ফারুক এবং হজরত আলী (রা.)-কে প্রেরণ করলেন, তাঁরা মসজিদের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করলেন, নিশ্চয়ই ৪০টি ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং যাদের ক্ষতি দ্বারা তার প্রতিবেশী ভীত হবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মু’জামে কবীর : ১৯/৭৩)।
তাই হজরত আবদুল্লাহ বিন আবু বকর (রহ.) তাঁর প্রতিবেশীর ঘরগুলোর মধ্যে ডানে-বামে এবং সামনে-পিছনে ৪০টি করে ঘরের লোকদের জন্য খরচ করতেন। ঈদের সময় তাদের জন্য কোরবানির মাংস ও কাপড় পাঠাতেন এবং প্রত্যেক ঈদে ১০০টি গোলাম আজাদ (মুক্ত) করতেন। (আল মুস্তাতরফ : ১/২৭৬)।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গাযালী (রহ.) বলেন : মনে রাখবেন! প্রতিবেশীর হক শুধু এটা নয় যে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা, বরং প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে পাওয়া কষ্টগুলো সহ্য করাও প্রতিবেশীর হকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এমনও হয়ে থাকে যে, এক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না এবং সেও এর বিনিময়ে তাকে কষ্ট দেয় না। অথচ সেইভাবে প্রতিবেশীর হক আদায় হয় না। সে জন্য শুধু কষ্ট সহ্য করার ওপর যথেষ্ট মনে করবে না, বরং প্রয়োজনবশত তার সঙ্গে নম্র এবং উত্তম আচরণ করবে। (ইহ্ইয়াউল উলুম, ২/২৬৭)।
প্রতিবেশীর হক আদায় করা, তাদের দেখাশোনা করা, অভাব পূরণ করা, তাদের অন্তর খুশি করা, তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, তাদের খুশি রাখা এবং তাদের কষ্ট না দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের যে মর্যাদাময় শিক্ষা রয়েছে, যদি বর্তমান মুসলমানরা সঠিকভাবে এই সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষাকে নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নেয় এবং সেগুলো অনুযায়ী আমল করে, তবে সেই দিন দূরে নয় যে, আমাদের সমাজে বাস্তবিক পক্ষে নিরাপত্তার দুর্গ হয়ে যাবে।
কিন্তু আফসোস! আমরা নূরনবীর শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, অন্যান্য বিষয়াবলির সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রতিবেশীর হক আদায় করার বিষয়েও হীনতার গভীর গর্তে পতিত হচ্ছি। একই গলি, মহল্লার মধ্যে বছরের পর বছর অতিবাহিত করার পর নিজের প্রতিবেশীদের পরিচয়, তাদের উপস্থিতি এবং প্রতিবেশীর হক থেকে উদাসীনতার অবস্থা এরূপ যে, যদি কোনো ব্যক্তি তার কোনো প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আসে আর আমাদের কাছে সেই গলি ও মহল্লার মধ্যে বসবাসকারী তার কোনো প্রিয়জনের পরিচয় জানতে চায়, তখন আমরা বগল দিয়ে দেখি এবং মাথা চুলকাই। আমাদের একেবারে খবর থাকে না যে, আমাদের প্রতিবেশীর মধ্যে কারা থাকে। তাদের নাম কী, কী কাজ করে। যখন প্রতিবেশীর মধ্যে কোনো মানুষ মারা যায় কিংবা কেউ অসুস্থ হয় অথবা কেউ পেরেশানির সম্মুখীন হয়, তখন আমরা সমবেদনা এবং সেবা করা অথবা তাকে সান্ত¡না দেয়ারও সামর্থ্য রাখি না।
হ্যাঁ! ধনী লোক, বড় ব্যবসায়ী, অফিসার, মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিশেষ বন্ধু, ভ্রাতা অথবা এমন প্রতিবেশী যাদের দ্বারা আমরা নিজেদের কাজ করাই, আমাদের কাছে তো তারা খুশি এবং পেরেশানি উভয় অবস্থায় আসে অথবা তারা আমাদের তাদের অনুষ্ঠানের মধ্যে দাওয়াত দিয়ে থাকে। কিন্তু গরিব প্রতিবেশীর কল্যাণ কামনা করা অথবা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা আমরা নিজেদের সম্মানের পরিপন্থি মনে করি। কতিপয় মূর্খ তো এমন অনুভূতিহীন হয়ে থাকে যে, ঘরের মধ্যে উপস্থিত ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, রোগী অথবা বিপদগ্রস্ত ভাইবোন, এমনকি পিতা-মাতাকেও পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করে না। তাহলে তারা ঘরের বাইরের প্রতিবেশীদের কী খবর রাখবে এবং তাদের কী হক আদায় করবে? বুজুর্গরা শুধু প্রতিবেশীদের হক আদায় করেননি, বরং অন্যান্য লোকেরও সেটার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গাযালী (রহ.) প্রতিবেশীদের হক বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন : প্রতিবেশীকে প্রথমে সালাম দেবে, তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলবে না, তাদের অবস্থা সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রশ্ন করবে না, যখন তারা অসুস্থ হয়, তখন তাদের সেবা করবে, বিপদের সময় তাদের পেরেশানি দূর করবে, কঠিন মুহূর্তে তাদের সঙ্গ দেবে, তাদের খুশির মধ্যে অংশগ্রহণ করবে, তাদের ভুল ক্ষমা করবে, নিজের ঘরের ছাদ থেকে তাদের ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখবে না, তাদের দেয়ালের ওপর কড়িকাঠ রেখে তাদের ছোট ড্রেনে পানি নিক্ষেপ করে এবং তাদের আঙিনায় মাটি ইত্যাদি নিক্ষেপ করে তাদের কষ্ট দেবে না, তাদের ঘরের রাস্তাকে সংকীর্ণ করবে না, তারা যা কিছু তাদের ঘরে নিয়ে যায় সেই দিকে দৃষ্টিপাত করবে না, যদি তাদের কোনো ঘটনা ঘটে, তখন তাড়াতাড়ি তাদের সাহায্য করবে, প্রতিবেশীদের অনুপস্থিতিতে তাদের ঘর রক্ষণাবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রকাশ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনবে না, তাদের (স্ত্রীদের) সামনে দৃষ্টি নত রাখবে, তাদের সন্তানদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলবে, ধর্মীয় এবং দুনিয়াবি যে কোনো বিষয়ে যখন তাদের পথ প্রদর্শনের প্রয়োজন হবে (তখন) সেই ক্ষেত্রে তাদের পথ প্রদর্শন করবে। (ইহ্ইয়াউল উলুম, ২/৭৭২)।
হজরত সায়্যিদুনা মালিক বিন দিনার (রহ.) একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেই বাড়ির সঙ্গে একেবারে লাগানো একজন অমুসলিমের বাড়ি ছিল। সে ঘৃণা এবং হিংসায় ছোট নালার মাধ্যমে দুর্গন্ধযুক্ত পানি এবং ময়লা তার ঘরের মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে; কিন্তু তিনি নীরব ছিলেন। অবশেষে একদিন সেই লোকটি নিজেই এসে আরজ করল : জনাব! আমার ছোট নালা দিয়ে যাওয়া অপবিত্রতার কারণে আপনার তো কোনো অভিযোগ নেই? তিনি অত্যন্ত নম্রভাবে বললেন : ছোট নালা দিয়ে যেই দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পতিত হয়, তা ঝাড়ু দিয়ে আমি ধুয়ে ফেলি। সে বলল : আপনার এত কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কোনো রাগ আসে না? তিনি বললেন : আসে, তবে তা হজম করে নিই। কেননা, আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : এবং ক্রোধ সংবরণকারীরা, মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনকারীরা এবং সৎ ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রিয়। [সুরা আলে ইমরান : ১৩৪]। উত্তর শুনে সে অমুসলিম মুসলমান হয়ে গেল। (তাজকিরাতুল আউলিয়া, ৫১ পৃ:)।