ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবী
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকেই মানবাধিকার বলে। মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সর্বোচ্চ সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণ অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মর্যাদা ও অধিকার বাস্তবায়নে অসংখ্য নবী-রাসুল এ ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করেছেন। ইসলামই সর্বপ্রথম মানবাধিকারের সুনির্দিষ্ট ধারণা মানব মস্তিষ্কে জন্ম দিয়েছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ‘কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ’ বলে ঘোষণা করেছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ও জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেছে। সর্বোপরি ইসলাম নারী-পুরুষ শিশু ও সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পক্ষান্তরে হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানিসহ সব অপরাধকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে হত্যা করল, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল। (সুরা মায়েদা : ৩২)। দয়াময় রব্বুল আলামিন আরও এরশাদ করেন, তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। (সুরা বাকারা : ১২৮)।

মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এরশাদ করেন, তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা কর তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। (সুরা নিসা : ৫৮)।

নারী অধিকারের বিষয়ে মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন- নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে পুরুষদের ওপর, যেমন পুরুষদের আছে তাদের (নারীদের) ওপর। (সুরা বাকারাহ : ২২৮)।

জাহেলিয়াতের যুগে নারী জাতি ছিল চরম নির্যাতিত। তাদের মানবীয় ন্যায্য অধিকার ছিল ভূলণ্ঠিত। অর্থ-সম্পদকে পুরুষ নিজেদের মালিকানা স্বত্ব মনে করত। উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে নারীদের ছিল না কোনো নির্ধারিত অংশ। স্বামীর মৃত্যু বা তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর ছিল না দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি। আরবীয় সমাজে নারী জন্মকে চরম অবমাননা, লাঞ্ছনা ও ঘৃণার কারণ মনে করা হতো। নারী জন্মের প্রতি তাদের ঘৃণা এতই প্রবল ছিল যে, নিষ্ঠুর পিতা নির্দয়ভাবে নিজ কন্যাকে জীবন্ত প্রোথিত করত। নারীর প্রতি এহেন অবহেলার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, সেই ব্যক্তি ভাগ্যবান যার প্রথম সন্তান হচ্ছে কন্যা।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন- তোমার মা। লোকটি বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল তারপর কে? তিনি বললেন তোমার মা। সে বলল তারপর কে? তিনি বললেন- তোমার পিতা। (বোখারি : ৫৫৪৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন- মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছোটবেলা থেকেই মানুষের অধিকারের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। এমনকি তাঁর ধাত্রী মা হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর কাছে থাকাকালীন স্বীয় দুগ্ধভাই আব্দুল্লাহর অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখে কখনও তার ধাত্রী মায়ের বাম স্তন থেকে দুগ্ধ পান করেননি। শুধু তাই নয়, তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে মক্কা মুকাররমার বাসিন্দা ও আগত মেহমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক একটি সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে দাস প্রথা ব্যাপক প্রচলিত ছিল। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থের বিনিময়ে এক শেণির মানুষকে দাসরূপে ক্রয় করত এবং তাদের প্রতি যারপরনাই জুলুমণ্ডঅত্যাচার করত। প্রিয়নবী (সা.) দাসদের ওপর এহেন নির্যাতন-নিপীড়নের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন করে দিয়ে বলেন- এরশাদ করেন, যে দাসদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। দাসদের মর্যাদার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, কোনো দাস যদি যোগ্যতার কারণে নেতৃত্ব পায়, তবে তোমরা তাকে মেনে চলবে। বিদায় হজের ভাষণে প্রিয়নবী (সা.) দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন : হে মানবজাতি! নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা (হজরত আদম আ.) এক। অতএব সাবধান! অনারবের ওপর আরবের, কিংবা আরবের ওপর অনারবের, শ্বেতাঙ্গ মানুষের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

ইসলাম সংখ্যালঘুদের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার এবং তাদের সম্পদ ও ধর্মীয় উপসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তার বিধান অক্ষুণ্ন রেখেছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো ধরনের অমানবিক আচরণ ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে এরশাদ করেন, সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করে, তাদের অধিকার খর্ব করে, তাদের ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয় কিংবা জোরপূর্বক তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করে, কেয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করব। (সুনানে আবু দাউদ)।

এভাবে মহানবী (সা.) মানবতার বার্তা নিয়ে এই ধরাধামে আগমন করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তা কাল থেকে কালান্তর মানব ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ, কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

প্রিন্সিপাল, মারকাযুল উলুম আজিজিয়া মাদ্রাসা, চাঁনমিয়া রোড, কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত